হলদিয়ার মাখনবাবুর বাজারে জলযোগ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। —নিজস্ব চিত্র।
রাজনীতিতে তিনি নিজেকে ‘নবাগত’ বলেন। নিজের সম্পর্কে বিচারপতির পদ ছেড়ে সদ্য রাজনীতিতে আসা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য অত্যুক্তি নয়। তবে শনিবার তমলুকে ভোটের দিন তাঁর মেজাজে অন্তত শিক্ষানবিশ রাজনীতিবিদের ছাপ ধরা পড়েনি। সকাল থেকে একেবারে হিসাব কষে বিভিন্ন বুথে গিয়েছেন। কোথাও দু’দণ্ড থেকেই বেরিয়ে এসেছেন, কোথাও ছাপ্পা দিতে আসার অভিযোগ শুনে কয়েক জন যুবককে সহযোগীদের দিয়ে তাড়া করিয়েছেন। আবার তৃণমূলের বিক্ষোভের মুখে নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। বুথে ঘোরার মাঝে হলদিয়ার মাখনবাবুর বাজারে গুমটি কচুরির দোকানের সামনে চেয়ার পেতে সেরেছেন প্রাতরাশ। পরিচিত সাংবাদিক, দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করেছেন। পথচলতি মানুষের সঙ্গে যেচে কথা বলে জনসংযোগও করেছেন।
এ সব দেখে রাজনৈতিক মহলের অন্দরেই গুঞ্জন, অভিজিৎ কি নিজ বুদ্ধিতেই এমন খাঁটি রাজনৈতিক আচরণ করেছেন, নাকি আড়ালে মন্ত্রণাদাতা অন্য কেউ? বিশেষ করে প্রবল রোদে বুথে ঘোরার সময় মাথা ঠান্ডা রাখা কিংবা নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে একেবারে চাপমুক্ত থাকার অভ্যাস পোড়া খাওয়া রাজনীতিবিদ ছাড়া সাধারণ মানুষের থাকে না। উপরন্তু, অভিজিৎকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন যে, খুব সহজেই রেগে যান তিনি। খোদ বিচারপতির চেয়ারে বসেও তাঁর রুদ্রমূর্তি বহুবার দেখা গিয়েছে। তিনি এ দিন এত শান্ত কী ভাবে? জবাবে শুধু মুচকি হেসেছেন।
তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ দিন তমলুক কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী নিজেকে হলদিয়া, ময়না, মহিষাদলের মতো কয়েকটা জায়গাতেই আটকে রেখেছিলেন। নন্দীগ্রামে যাননি। সেখানে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী স্বয়ং। নন্দীগ্রাম নিয়ে কার্যত কোনও কথাই এ দিন বলতে দেখা যায়নি অভিজিৎকে। বরং শেষবেলায় বলেছেন, “পূর্ব মেদিনীপুরের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ শিশির অধিকারী। এখন তাঁর জুতোয় পা গলিয়েছেন ছেলে শুভেন্দু। মেদিনীপুরের উপরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ আছে।”
ভোর পাঁচটা নাগাদ রামতারকের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন অভিজিৎ। তার পর সকালেই হলদিয়ার দু’টি জায়গায় অভিজিৎকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তৃণমূল সমর্থকেরা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একদা জেহাদ ঘোষণা করা বিচারপতিকে সাতসকালে ভোট শুরুর আগেই ‘চোর চোর’ বলে আওয়াজ দিয়েছেন তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা। তবে সে সব শুনে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি তিনি। নির্বাচন কমিশনে ফোন করিয়ে বাহিনী এনে ভিড় সরিয়েছেন। বুথে বিজেপি এজেন্টকে বসতে না-দেওয়ার অভিযোগ শুনে গিয়ে এজেন্ট বসিয়ে এসেছেন। কথা না শোনায় নিজের দলের এজেন্টকে বকুনিও দিয়েছেন।
বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ খবর আসে হলদিয়া ভবানীপুর শান্তিশ্রী বিবেকানন্দ কন্যা বিদ্যামন্দিরে ছাপ্পা ভোটের চেষ্টা হচ্ছে। নিজের রক্ষী এবং সহযোগীদের নিয়ে সেখানে পৌঁছন অভিজিৎ। বুথ ঘুরে বেরিয়েই দেখা যায়, ভোটার কার্ড ছাড়া ভোটকেন্দ্রের কাছে ঘুরঘুর করছেন তিন যুবক। বিজেপি প্রার্থীর সহযোগীরা চেপে ধরতেই হাত ছাড়িয়ে মাঠের উপর দিয়ে দৌড়ে পালান ওই তিন জন। তার পরেই তৃণমূল কর্মীরা জমায়েত করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সেই বিক্ষোভের মুখে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন অভিজিৎ। তাঁকে ঘিরে রাখে কেন্দ্রীয় বাহিনী। পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকে। একসময় অভিজিৎকে বিড়বিড় করে বলতে শোনা যায়, “চাইলে দু’মিনিটে ভিড় পাতলা করে দেওয়া যায়। কিন্তু আমি দেখছি, কত বাড় এরা বাড়তে পারে!” পরে অবশ্য বাহিনী ডেকে সেই ভিড় পাতলা করেছেন।
তবে অনেকেই লক্ষ্য করেছেন, তৃণমূল সমর্থকরা বিক্ষোভ দেখিয়ে একদিকের পথ আটকে রাখলেও আর এক দিকের রাস্তা দিয়ে প্রচুর মানুষ এসেছেন এবং নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে গিয়েছেন। তবে কি বিরোধীর গড়ে নিজের দলের ভোট যাতে নিশ্চিত থাকে, সেই ছকে বিক্ষোভের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি? এখানেও শব্দে উত্তর নেই, শুধু মুচকি হাসি। এই ঘটনার পরে হলদিয়া হাসপাতাল ঘুরে মহিষাদল পার্টি অফিসে গিয়ে বিশ্রাম নিয়েছেন, দুপুরের খাবার খেয়েছেন। একটু জিরিয়ে আবার বেরিয়ে ময়না বৃন্দাবনচকে গিয়েছেন। দলীয় প্রার্থীর বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে শুনে হাজির হয়েছেন। পুলিশের সঙ্গে শান্ত ভাবে কথা বলেছেন, সমাধান না হওয়া ইস্তক ওই পাড়ার রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে চাতালে বসে থেকেছেন। শেষ বেলায় ভোটের ফলাফল কী হবে, তা নিয়েও সাবধানী মন্তব্য শোনা গিয়েছে অভিজিতের গলায়। বলেছেন, “ফলাফল নিয়ে আমি কোনও পূর্বাভাস করি না।”
শেষ সংলাপও যেন নিখুঁত অঙ্ক অথবা চিত্রনাট্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy