বাঁ দিক থেকে, সৌগত রায়, শীলভদ্র দত্ত এবং সুজন চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
পোড় খাওয়া, বর্ষীয়ান রাজনীতিকের মোবাইলের কলার টিউনটি চমকপ্রদ! ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়/ আমি তারি লাগি পথ চেয়ে আছি, পথে যে জন ভাসায়!’ এমন ভরা ভোটের আবহে দমদমের মতো উত্তপ্ত রণক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের তিন বারের সাংসদের ফোনে এ হেন গানের কলি কি ইঙ্গিতবাহী? সৌগত রায়ের নিরাসক্ত অল্পোক্তি, ‘‘যা মনে করেন! গানটা ভাল। অনেক দিন ধরেই আছে।’’
শুনে মুচকি হাসেন সুজন চক্রবর্তী। ‘‘প্রথমে যখন দমদমে আমাকে প্রার্থী করা হল, সৌগতদা দারুণ নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, সুজন বিজেপির অনেকটা ভোট কেটে নেবে। আর সেই কাটাকুটির খেলায় হাসতে হাসতে উনি জিতবেন! তবে যত দিন যাচ্ছে, সর্বনাশের আশা বাড়ছে ওঁর!’’
কিন্তু ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ সব ভোট কেটে নেওয়ার ‘ক্যারিশমা’ যদি সিপিএমের সুজনের থাকে, তা হলে ২০২১-এ যাদবপুরে বিধানসভায় হারলেন কেন? ‘‘কেনই বা তাঁকে পুরনো চেনা এলাকা ছেড়ে দমদমে পাঠানো হল?’’ প্রশ্নটা দমদমের বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্তের। প্রাক্তন আইনজীবী যুক্তি দেন, ২০১৯-এ দমদমে ১৪% ভোট পেয়েছিলেন সিপিএমের নেপালদেব ভট্টাচার্য। বিজেপি পেয়েছিল ৩৮% ভোট। আর তৃণমূল ৪৩% ভোট। বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য হেরেছিলেন ৫৩ হাজার ভোটে। সিপিএমকে এখানে জিততে হলে ১৪% ভোটকে ৪২% করতে হবে বলে দাবি করে শীলভদ্রের মন্তব্য, ‘‘খেলা অত সহজ নয়!’
দমদমে ভোট-নাট্যের প্রধান কুশীলব এ বার সৌগত-র ‘স’, সুজনের ‘স’ এবং শীলভদ্রের ‘শ’। তত্ত্ববিদ কাকেশ্বর কুচকুচেরা স্লেট-পেনসিল নিয়ে ‘হিসাবি-বেহিসাবি, খুচরা-পাইকারি সকল প্রকার গণনা কার্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন’ করার চেষ্টা শুরু করেছেন। তবে হিসাব অতি ঘাঁটা।
সাতের দশকে এলাকা পুনর্বিন্যাসে তৈরি দমদম কেন্দ্রে এক সময় ছিলেন প্রচুর ছিন্নমূল। এখন প্রচুর শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী মানুষের বাস এখানে। রাজনীতিসচেতন এবং বামমনস্ক ভোটার যথেষ্ট। রয়েছে কলোনি এবং শ্রমিক লাইন। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বেড়েছে ভিন্ রাজ্য, বিশেষ করে বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা মানুষ। পাড়ায়-পাড়ায় গজিয়েছে হনুমান মন্দির, শোনা যাচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। সংখ্যালঘু বসতি তুলনায় কম। এক সময়ে বামেদের এই দুর্গে সিপিএমের প্রধানতম ভোট-মেশিনের নাম ছিল সুভাষ চক্রবর্তী। তৃণমূলের সহযোগিতায় এই দমদমে যখন প্রথম বার পদ্ম ফোটে, সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্ব তখন চর্চায়। বিজেপির তপন শিকদারের জয়ের হ্যাটট্রিক থামিয়ে ২০০৪ সালে সিপিএমের দমদম পুনরুদ্ধারের কারিগর ছিলেন সুভাষই। তবে পরের বারই, ২০০৯-এ জিতে যান তৃণমূলের সৌগত রায়। দমদম বাম ঘাঁটি থাকার সময়ে যেমন তৎকালীন শাসক দল সিপিএমে অন্তর্কলহ ছিল, প্রবীণ সৌগতের চতুর্থ বার সাংসদ হওয়ার দৌড়ের সময়ে তৃণমূলকে ঘিরেও ফিরেছে একই চর্চা।
দমদমের সাত বিধানসভা জুড়ে ঘাসফুলের সাজানো বাগানে গত কয়েক বছরে আচমকা পদ্মের আধিক্য প্রবীণ তৃণমূল সাংসদের অস্বস্তির কারণ হয়েছে। এত দিন সাংসদ থাকার সুবাদে এমনিতেই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা জন্ম নেয়, তার উপরে রয়েছে সামগ্রিক ভাবে শাসক দলের উপরে জমে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ, বেহাল রাস্তাঘাট, জমা জল, বেআইনি নির্মাণ ও পার্কিং, পানীয় জলের সমস্যা, বন্ধ কারখানা, অসমাপ্ত আন্ডারপাস, ধুঁকতে থাকা হাসপাতাল নিয়ে মানুষের ক্ষোভ। আর সব কিছু ছাপিয়ে রয়েছে এলাকায় এলাকায় তৃণমূলের তুমুল গোষ্ঠী-কোন্দল এবং চোরা গেরুয়া স্রোত। ঘাসফুলের অতি সুহৃদ কর্মকর্তাও স্বীকার করছেন, “দাদা চাপে আছেন। তা না-হলে একটা কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও এত বার প্রচারে আসেন?”
দমদমের অলিতে-গলিতে চলছে চর্চা। মমতার সভায় আশানুরূপ লোক হয়নি। সভায় দাদার প্রশংসা করে ‘দিদি’ জানিয়েছেন, যে কোনও নিমন্ত্রণবাড়িতে ডাকলেই সৌগতকে পাওয়া যায়। চায়ের আড্ডা বলেছে, “নিমন্ত্রণবাড়িতে বা বলিউড নায়িকার সঙ্গে মঞ্চে হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু কাজের সময় দাদার দেখা মেলে না!” শেষ বেলায় তাই মানুষের পাশে দাঁড়াতে মরিয়া ‘দাদা’ রেমাল-বিধ্বস্ত পাড়ায় জেসিবির আসনে বসে ভাঙা চিমনি সরিয়েছেন, বাঁশ নিয়ে হাঁটুজলে নেমে নর্দমা খুচিয়েছেন।
এরই মধ্যে বরানগর বিধানসভায় জটিলতা বাড়িয়ে তাপস রায় শিবির বদলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ব্যারাকপুর-দমদম সাংগঠনিক জেলার মাথায় ছিলেন তাপস। তিনি চলে যাওয়ায় সংগঠনের একাংশে ধাক্কা লেগেছে। তেমনই আবার বামেরা এ বার হেভিওয়েট প্রার্থী দেওয়ায় সংখ্যালঘু ভোটের বেশ কিছুটা তৃণমূল থেকে কেটে বাম-কংগ্রেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে শাসক শিবিরে।
যদিও এই সব কিছুকে ‘আনন্দবাজারীয় তত্ত্ব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন সৌগত। পরিবর্তে দাবি করেছেন, বামেদের জেতার আশা দুরাশা। দমদমে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি। কিন্তু সাংসদের দাবি, শীলভদ্র জিতবেন না। সেই গ্রহণযোগ্যতা তাঁর নেই। সুজন রামে যাওয়া বামের ভোট ফেরাবেন, ভোট কাটবেনও। তাতে লাভ তৃণমূলের।
শীলভদ্র আবার সিপিএমের জয় কেন ‘অসম্ভব’, পাল্টা সেই অঙ্ক দেখাচ্ছেন। তাঁর যুক্তি, দমদমে জিততে হলে সিপিএমকে যত ভোট টানতে হবে, সেই পরিস্থিতি নেই এবং ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করার সুভাষ চক্রবর্তীও নেই! তা বলে তিনি চাপমুক্ত নন মোটেই। প্রচারের দিক দিয়ে তৃণমূল ও বামেদের থেকে তিনি অনেকটা পিছিয়ে। মুখে দাবি করছেন, “বিজেপি-র পদ্ম প্রতীক আর মোদীর নামই যথেষ্ট। প্রার্থী নয়, এখানে দল মুখ্য।”
এ বার আর বাম ভোট অন্য কোথাও পড়বে না বলে নিশ্চিত গত আড়াই মাস ধরে প্রচারে কার্যত ঝড় তোলা সিপিএমের লড়াকু নেতা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন। তাঁর আত্মবিশ্বাসী দাবি, “জনতা বামেদের ৪৫% থেকে ১৪%-এ নামাতে পারলে এক ধাক্কায় উল্টোটাও করতে পারে। এবং সেই অবস্থাটা এ বার দমদমে তৈরি হয়েছে।” হাতে হাতে তিনি বিলোচ্ছেন ‘দমদম মাস্টারপ্ল্যান।’ সাংসদ হলে ৭ বিধানসভার কোথায় কী কী করবেন, তার খতিয়ান। তাঁর প্রচারে তরুণ ব্রিগেডের উপস্থিতি তাক লাগানো। এ ছাড়া, সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাট, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ সেলিম থেকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী —কেউ বাকি নেই তাঁর হয়ে প্রচারে আসতে। কেবল ভোট বাড়ানো নয়, জয়ের লক্ষ্যেই এ বার দমদমে ঝাঁপিয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেস।
দমদম তাঁকে ‘প্রকৃত সুজন’ মনে করলে বামেদের পুরনো গড় পুনরুদ্ধার হলেও হতে পারে। আবার তিনি কত ভোট কাটতে পারলেন, তার উপরে দুই ফুলের ফোটা বা শুকিয়ে যাওয়া নির্ভর করতে পারে। ‘স, স ও শ’-এর ভোট-নাট্য আপাতত ‘ক্লাইম্যাক্স’-এ দাঁড়িয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy