গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা নির্বাচনের আগে হিমাচল প্রদেশে পতনের মুখে কংগ্রেসের সরকার। সে রাজ্যের একটি মাত্র রাজ্যসভা আসনের ভোটে মঙ্গলবার জিতেছেন বিজেপির প্রার্থী হর্ষ মহাজন। তিনি হারালেন কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিকে। কংগ্রেসের ছ’জন-সহ অন্তত ন’জন বিধায়কের ক্রস ভোটিংয়ের জেরেই এই ফলাফল বলে অভিযোগ।
৬৮ সদস্যের বিধানসভায় দু’পক্ষই ৩৪টি করে ভোট পাওয়ায় লটারির মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় হিমাচলে। সেখানে রাজ্যসভার একটি আসনে সরাসরি লড়াই ছিল শাসক কংগ্রেস এবং বিরোধীদল বিজেপির। ফলে ক্রস ভোটিংয়ের কারণে কংগ্রেস প্রার্থী হেরে যাওয়ায় সরাসরি প্রশ্ন উঠল মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিংহ সুখুর সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। লোকসভা ভোটের আগেই সে রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটবে বলে মঙ্গলবার দাবি তুলেছে বিজেপি।
এর মধ্যেই কংগ্রেস বিধায়কদের অপহরণের অভিযোগ তুললেন হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পাঁচ-ছ’জন বিধায়ককে অপহরণ করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআরপিএফ এবং বিজেপি শাসিত হরিয়ানার পুলিশ।’’ তাঁদের হরিয়ানা নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সুখু। ভোটের ফল প্রকাশের পরে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেছেন, ‘‘হিমাচলে গণতন্ত্রকে খুন করল বিজেপি।’’
মঙ্গলবার বিকেলে ৫টায় রাজ্যসভা ভোটের গণনা শুরু হলেও বিধানসভা ভবনে বিজেপি এবং কংগ্রেস বিধায়কদের মধ্যে তুমুল গন্ডগোলের জেরে তা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়। অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয় বিধানসভা অধিবেশন। পরে সন্ধ্যায় কড়া নিরাপত্তায় শুরু হয় গণনা। হিমাচলের পাশাপাশি, উত্তরপ্রদেশে রাজ্যসভা ভোটের গণনা নিয়েও শাসক বিজেপি এবং বিরোধী সমাজবাদী পার্টির মধ্যে গন্ডগোলের জেরে সাময়িক ভাবে গণনা মুলতুবি রাখা হয়। রাতে শুরু হয়েছে গণনা।
হিমাচলের পাশাপাশি বিজেপি ‘ক্রস ভোটিং’-এর সুফল পেয়েছে উত্তরপ্রদেশে। সেখানে ১০টি আসনের মধ্যে আটটিতে জিতেছে তারা। সমাজবাদী পার্টির এক প্রার্থী পরাস্ত হয়েছেন। জিতেছেন জয়া বচ্চন-সহ দুই প্রার্থী। অন্য দিকে, দক্ষিণের রাজ্য কর্নাটকে শাসক কংগ্রেসের তরফে ‘ক্রস ভোটিং’ করেন বিরোধী বিজেপির এক বিধায়ক। সেখানে চারটির মধ্যে তিনটি রাজ্যসভা আসনে জিতেছে কংগ্রেস।
আগামী এপ্রিলে ১৫টি রাজ্যের ৫৬ জন রাজ্যসভার সদস্য অবসর নিতে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ, উত্তরপ্রদেশের ১০, অন্ধ্রপ্রদেশের তিন, বিহারের ছয়, ছত্তীসগঢ়ের এক, গুজরাতের চার, রাজস্থানের তিন, হরিয়ানার এক, হিমাচল প্রদেশের এক, কর্নাটকের চার, মধ্যপ্রদেশের পাঁচ, মহারাষ্ট্রের ছয়, তেলঙ্গানার তিন, উত্তরাখণ্ডের এক এবং ওড়িশা থেকে তিন জন নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১৩টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৪১ আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের বিধায়ক সংখ্যার অনুপাতে প্রার্থী দেওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ভোটপর্ব মিটে যায়। মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ হয় উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক এবং হিমাচলের মোট ১৫টি আসনে।
হিমাচলে হারে পতন হবে কংগ্রেস সরকারের?
হিমাচলে কংগ্রেস পরিষদীয় দলে ভাঙনের আঁচ মিলেছিল মঙ্গলবার সকালেই। হিমাচলের প্রদেশ কংগ্রেস সভানেত্রী তথা লোকসভা সাংসদ প্রতিভা সিংহ বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারের কার্যকলাপে কংগ্রেস বিধায়কদের একাংশের ক্ষোভ রয়েছে। রাজ্যসভা ভোটে তার প্রভাব পড়তে পারে।’’ কংগ্রেসের অন্দরের রাজনীতিতে প্রতিভা ‘সুখু বিরোধী’ হিসাবে পরিচিত। এর পরে দুপুরে ভোট চলাকালীনই ‘খবর’ মিলেছিল কংগ্রেসের অন্তত ছ’জন বিধায়ক বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী সুখুও ক্রস ভোটিংয়ের কথা স্বীকার করে নেন।
তার পরেই জল্পনা তৈরি হয় পরিষদীয় পাটিগণিতের হিসাবে এগিয়ে থেকেও কংগ্রেস প্রার্থী সিঙ্ঘভি তাঁর বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী হর্ষের কাছে হারতে চলেছেন। হিমাচলের এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক কংগ্রেস বিধায়ককে মঙ্গলবার ভোট দেওয়ানোর জন্য বিধানসভায় আনা হয় সুখুর উদ্যোগে। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ছ’জন ‘ক্রস ভোটিং’কারী কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপি শাসিত হরিয়ানায় আশ্রয় নেওয়ার সুখু সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করা কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। রাজ্যসভা ভোটে শাসকদলের হারের জেরে রাজ্যপাল এ বার মুখ্যমন্ত্রীকে আস্থাভোট নেওয়ার নির্দেশ দতে পারেন বলে জল্পনা রয়েছে।
৬৮ আসনের হিমাচল বিধানসভায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ৪০। এ ছাড়া তিন জন নির্দল বিধায়ক সুখু সরকারকে সমর্থন করছেন। অন্য দিকে, বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ২৫। অর্থাৎ, সরকার পক্ষের ন’জন বিধায়ক বিজেপি প্রার্থীকে হর্ষকে ভোট দিয়েছেন। সূত্রের খবর, ছ’জন কংগ্রেস এবং তিন নির্দল রয়েছেন সেই দলে। ঘটনাচক্রে, সুখুর বিরোধী অন্তত ছ’জন কংগ্রেস বিধায়ক কাংড়া অঞ্চলের বাসিন্দা। বিজেপি প্রার্থী হর্ষ কাংড়ার প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা। প্রতিভা এবং তাঁর পুত্র তথা হিমাচলের মন্ত্রী বিক্রমাদিত্যের সঙ্গেও তাঁর ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে বলে সূত্রের খবর। তা ছাড়া, হিমাচলের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহের স্ত্রী পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দরের আত্মীয়। অমরিন্দর বর্তমানে বিজেপিতে।
প্রতিভার পুত্র তথা সুখু সরকারের মন্ত্রী বিক্রমাদিত্য গত মাসে দলীয় অবস্থানের উল্টো রাস্তায় হেঁটে অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বিধায়কদলে ভাঙনের আঁচ পেয়ে ক্ষোভ প্রশমনের জন্য সনিয়া গান্ধীকে হিমাচলে প্রার্থী হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন সুখু। সে ক্ষেত্রে ক্রস ভোটিংয়ের সম্ভাবনা অনেক কমত বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত। কিন্তু তা না মেনে, রাজস্থানে প্রার্থী হন প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রী। ঘটনাচক্রে, হিমাচলে কংগ্রেস সংগঠনের দায়িত্বে রয়েছেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা। সে রাজ্যের রাজধানী শিমলায় তাঁর বাড়িও রয়েছে।
কর্নাটকে ‘ক্রস ভোটিং’-এ লাভ কংগ্রেসের
হিমাচলে বিপর্যস্ত হলেও বিন্ধ্য পর্বতের ওপারে দাক্ষিণাত্যে ‘ক্রস ভোটিং’য়ের সুফল পেল কংগ্রেস। বিরোধী বিজেপি-জেডিএস জোটকে হারিয়ে রাজ্যসভা ভোটে কর্নাটকের তিনটি আসন দখল করল সে রাজ্যের শাসকদল। বিরোধী জোটের দখলে গিয়েছে একটি।
কর্নাটক বিধানসভার অঙ্ক অনুযায়ী চারটি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের তিনটি এবং প্রধান বিরোধী দল বিজেপির একটিতে জেতার কথা ছিল। কিন্তু আর এক বিরোধী দল জেডিএসের সঙ্গে জোট বেঁধে দু’টি আসনে লড়তে নেমেছিল পদ্মশিবির। কিন্তু সেখানে ‘ক্রস ভোটিং’ বুমেরাং হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দলের। কংগ্রেসের প্রার্থীকে ভোট দেন প্রভাবশালী বিজেপি বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী এসটি সোমশেখর গৌড়া।
প্রসঙ্গত, কর্নাটক বিধানসভার আসন সংখ্যা ২২৪। এর মধ্যে একটি আসন খালি। কংগ্রেসের ১৩৪, বিজেপির ৬৬, জেডিএসের ১৯ জন বিধায়ক রয়েছেন। সর্বোদয় কর্নাটক পক্ষের ১, কল্যাণ রাজ্য প্রগতি পক্ষের ১ এবং ২ নির্দল বিধায়ক ছিলেন কংগ্রেসের পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এবং উপমুখ্যমন্ত্রী ডিকে শিবকুমারের যুগলবন্দি খড়্গের রাজ্যে জয় এনে দিয়েছে কংগ্রেসকে।
উত্তরপ্রদেশে অখিলেশের দল ভাঙল বিজেপি
হিমাচলের এক এবং কর্নাটকের পাঁচ আসনের পাশাপাশি মঙ্গলবার ভোট হয় উত্তরপ্রদেশের ১০টি রাজ্যসভা আসনে। সে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র পাঁচ বিধায়ক বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পরে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে।
উত্তরপ্রদেশে বিধায়ক সংখ্যার হিসাবে সাতটি আসনে বিজেপি প্রার্থীর জয় নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের দলের তিন প্রার্থীর জয় চলতি মাসের গোড়া পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় লোক দলের এনডিএ-তে যোগদান এবং দু’জন এসপি বিধায়কের প্রকাশ্যে বিজেপি প্রার্থীকে সমর্থনের ঘোষণার পরে চিত্র পাল্টায়। বিজেপি প্রথমে সাত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বিরোধী শিবিরের হালচাল দেখে অষ্টম আসনেও প্রার্থী দেয়। এই পরিস্থিতিতে অখিলেশের উপর চাপ বাড়িয়ে ‘বাহুবলী’ বিধায়ক রাজা ভাইয়া এবং তাঁর দল জনসত্তা পার্টির এক বিধায়ক বিজেপিকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন।
বতর্মানে ৪০৩ আসনের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় চারটি আসন খালি। ভোট দেন ৩৯৯ জন বিধায়ক। রাজ্যসভায় এক জন প্রার্থীকে জিততে পেতে হবে ৩৭টি ভোট। আট প্রার্থীকে জেতাতে বিজেপির প্রয়োজন ২৯৬টি ভোট। তাঁদের পক্ষে ছিল ২৮৬টি ভোট (বিজেপি: ২৫২, আপনা দল: ১৩, নিষাদ দল: ৬, এসবিএসপি: ৬, আরএলডি: ৯)। সব মিলিয়ে ১০টি ভোট কম ছিল বিজেপির। কিন্তু রাজ্যসভা ভোটে ক্রস ভোটিংয়ের সম্ভাবনাকে আরও উস্কে দিয়ে মঙ্গলবার সকালে পদত্যাগ করেন উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় এসপি-র মুখ্যসচেতক মনোজ পাণ্ডে। তিনি এবং আরও চার এসপি বিধায়ক মঙ্গলবার বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দেন বলে সূত্রের খবর।
তিন প্রার্থীকে জেতাতে অখিলেশের দলের প্রয়োজন ছিল ১১১টি ভোট। তাদের বিধায়ক সংখ্যা ১০৮। কিন্তু তার মধ্যে দু’জন জেলবন্দি। এসপির পক্ষে কংগ্রেসের দুই বিধায়ক ও নির্দলের দু’জন প্রার্থী। কিন্তু দলের পাঁচ বিধায়ক বিজেপির পক্ষে ভোট দেওয়ায় পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। হিমাচলের মতোই উত্তরপ্রদেশে রাজ্যসভা ভোটেও নিয়ে শাসক বিজেপি এবং বিরোধী সমাজবাদী পার্টির মধ্যে গন্ডগোলের জেরে সাময়িক ভাবে গণনা মুলতুবি রাখা হয়। রাতে শুরু হয় গণনা। শেষ পর্যন্ত সমাজবাদী পার্টিকে পরাস্ত করে বিজেপি অষ্টম আসনটি জিতে নেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy