সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
ডানলপ মোড় থেকে খানিক এগিয়েই গলির মুখে টালির ছাউনি দেওয়া ঘরের দরমার বেড়ায় পাশাপাশি ঝুলছে দু’টি ব্যানার। একটিতে জোড়া ফুলের প্রার্থীর ছবি, সঙ্গে লেখা ‘লেবুতলার গুন্ডা নয়, বরাহনগর ঘরের মেয়েকেই চায়’। অন্যটিতে পদ্ম-প্রার্থীর ছবি দিয়ে লেখা ‘অভিনেত্রী নয়, এই লড়াই দুর্নীতির দলনেত্রীর বিরুদ্ধে’।
অদ্ভুত ভাবে, দু’টি ব্যানারের প্রচারক একই! তাঁরা নিজেদের বরাহনগরের বাসিন্দা এবং সিটি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ বলে দাবি করেছেন। বরাহনগরে বিধানসভা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের এ হেন ‘ব্যানার-লড়াই’ ঘিরে বেশ তেতে উঠেছে সেখানকার রাজনৈতিক মহল। সব দেখে-শুনে ওই দুই ব্যানারের পাশেই বেড়ায় সাঁটা কাস্তে-হাতুড়ি-তারা প্রতীকের প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘আসলে তৃণমূল ও বিজেপি, উভয়েই তো গুন্ডা-মস্তানির রাজনীতি করে। তাই এমন ভাবে প্রচার করে কে বড় মস্তান, সেটাই হয়তো প্রমাণের চেষ্টা করছে তারা। বরাহনগর এ সব মানবে না।’’
যদিও তৃণমূলের সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপির সজল ঘোষ— উভয়েরই দাবি, ব্যানারের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। তবে সজল এটাও বলছেন, ‘‘বরাহনগরের অনেকেই সিটি কলেজের প্রাক্তনী। তাঁরা আমাকে চেনেন, জানেন।’’ আর ছাত্র রাজনীতির সেই ‘পুরনো সম্পর্ক’কেই তলে তলে ব্যবহার করে লেবুতলার ‘দেবু’ (সজলের ডাক নাম) ভোট-লড়াইয়ে ছক্কা হাঁকাতে চাইছেন বলেও রাজনৈতিক শিবিরের পর্যবেক্ষণ। সেই অনুমান যে একেবারে ভুল নয়, তা আড়ালে মানছেন শাসক শিবিরের একাংশও। যদিও প্রকাশ্যে তাঁদের দাবি, ‘‘পুরনো আবেগ থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।’’
বরাহনগরের ‘ভোট বাক্স’-এর অনেকটাই লক্ষ্মীর ভান্ডার দ্বারা সুরক্ষিত বলে দাবি স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের। তাঁদের কথায়, ‘‘এখানে পুরুষদের থেকে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি। সেই সংখ্যার অন্তত ৬০ শতাংশ পেলেই জয়ের বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত আমরা।’’ রাজনৈতিক শিবিরের মতে, দাবিটা অমূলক নয়। কারণ, বরাহনগরে প্রায় ৫২ শতাংশ মহিলা ভোট রয়েছে। সেই ভোটের কারা কতটা নিজেদের ঝুলিতে নিতে পারবে, সেটাও বড় ‘ফ্যাক্টর’। সজলের অভিযোগ, ‘‘জঞ্জাল সাফাইয়ের নামে দোকান, বাড়ি থেকে তৃণমূল এখানে টাকা তোলে। আরও অনেক রকমের দুর্নীতি রয়েছে। তাই কেউ ওদের ভাল ভাবে নিচ্ছেন না।’’
পাশাপাশি, ২০১১ থেকে বরাহনগরে টানা তিন বারের বিধায়ক ছিলেন তৃণমূলের তাপস রায়। এলাকার সর্বস্তরের নেতা, কর্মী থেকে প্রভাবশালী, সকলেরই ‘হাঁড়ির খবর’ বা ‘দুর্বলতা’ কার্যত জানেন এখন পদ্ম শিবিরের তাপস। ফলে, বরাহনগর-যুদ্ধের ‘নকশা’ তিনি সজলের হাতে তুলে দিয়েছেন বলেও ধারণা রাজনৈতিক শিবিরের। যা হাতিয়ার করে নিঃশব্দে সজলও কার্যত একাংশের উপরে পরোক্ষ ‘চাপ’ তৈরি করে বাজিমাত করতে চাইছেন বলে ধারণা অনেকেরই। যদিও এই সমস্ত ‘চোরকাঁটা’-কে প্রাধান্য দিতে নারাজ সায়ন্তিকা।
বরং তিনি অভিনেত্রী ভাবমূর্তি সরিয়ে রেখে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ডের অলিগলিতে ঘুরে প্রচার সারছেন। বলছেন, ‘‘সারা বছর পড়াশোনা না করে শুধু পরীক্ষার সময়ে রাত-দিন এক করে পড়েও লাভ হয় না। এখানে সেই অবস্থা বিজেপি প্রার্থীর। সারা বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন ও প্রকল্পের সুফল বরাহনগরবাসী পেয়েছেন। তাই এই পরীক্ষায় কোনও কিছুই বাধা হবে বলে মনে হয় না।’’ তবে তন্ময়কে নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন নিজেকে রাজনীতিতে ‘শিক্ষানবিশ’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা সায়ন্তিকা। ২০২১-এ বিধানসভা ভোটে হারের পরে তিন বছর বাঁকুড়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকে অনেক কিছু শিখেছেন বলেই তাঁর দাবি। সেই শিক্ষা থেকেই ভোট-যুদ্ধে কিস্তিমাত করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী সর্বক্ষণ ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি’ পরিচয় দেওয়া সায়ন্তিকা।
১৯৫১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বরাহনগরের বিধায়ক ছিলেন জ্যোতি বসু। প্রায় ৫২ বছর বাদে আবার বরাহনগর ‘কাস্তে-হাতুড়ি-তারা’ প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছে। সেই আবেগ, ভূমিপুত্র এবং নিজস্ব পরিচিতিতে আত্মবিশ্বাসী তন্ময়। বলছেন, ‘‘বামপন্থার দিকে একটা স্রোত কাজ করছে। তাতে আমাদের ভোট শতাংশ বাড়বে। ৯০ শতাংশ ভোট ফিরে আসবে বলেই বিশ্বাস।’’ যদিও সূত্রের খবর, তন্ময়ের প্রার্থী হওয়াকে মোটেই ভাল চোখে দেখেননি বরাহনগরে সিপিএমের পুরনো দিনের নেতাদের একাংশ। সেই চোরাস্রোত ঠেলে কি আদৌ সিপিএমের ভোট বাড়বে? পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মাত্র ১২.৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন বরাহনগরে। যদিও সব কিছু নস্যাৎ করে তন্ময়ের দাবি, ‘‘২০১৬-তে আরএসপি প্রার্থী ৩৮.৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। তার পুরোটাই এ বারও বজায় থাকবে। সঙ্গে আরও কিছু ভোট তো যোগ হবেই।’’
‘মাত্র দু’বছরের জন্য সুযোগ দিন’— এই আহ্বান জানিয়ে ভোট টানতে অলিগলিতে ঘুরছেন সজলও। মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ছেন অন্দরমহলেও। বলছেন, ‘‘পুর ভোটের মতো করে প্রচার করছি।’’ কিন্তু অভিমানী নেতা-কর্মীদের একাংশ কার্যত হাত গুটিয়ে থাকায় পদ্ম-প্রার্থীর কতটা সুবিধা হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই গিয়েছে। শাসকদলের নেতারা বলছেন, ‘‘বিজেপির তো সংগঠনই নেই। হাতে গোনা সাত-আট জনকে নিয়ে প্রার্থী মিছিল করছেন।’’ সব শুনে হাসছেন সজল। বলছেন, ‘‘সব উত্তর মিলবে ৪ জুন।’’
প্রতিপক্ষদের জায়গা ছাড়তে নারাজ সায়ন্তিকাও। বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে নিজস্বী তোলার আবদার মেটানোর পাশাপাশি কোলে তুলে নিচ্ছেন বাচ্চাদের। তার ফাঁকে বলছেন, ‘‘উনি (সজল) আমার পরিবারকে নিশানা করে কুকথা বলে আক্রমণ করছেন। সব উত্তর দেব ফলাফলের দিন।’’ উপনির্বাচনের লড়াইয়ে বরাহনগর সরগরম হলেও প্রার্থীদের মিল রয়েছে প্রচারে। তৃণমৃল ও বিজেপির প্রার্থীরা হ্যান্ড মাইক ফুঁকে রাজপথ থেকে তস্য গলিতে ভোট-প্রার্থনা করছেন। চরকিপাকে কম যাচ্ছেন না ষাটোর্ধ্ব তন্ময়ও। ফলে, হাওয়া বুঝে ভোটের দিন সিদ্ধান্ত নেন যে ১০-১২ শতাংশ ভোটার, তাঁদের কে কতটা টানতে পারবেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy