ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ান। —নিজস্ব চিত্র।
ওড়িশার ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার কৌশল নিলেও বিজু জনতা দল (বিজেডি) সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে কখনও আপস করবে না বলে দাবি করলেন দলের নেতা ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ান।
নবীন পট্টনায়কের পরে দলে কার্যত দ্বিতীয় এবং ‘নির্বাচন রণনীতি মুখ্য’ পদাধিকারী পান্ডিয়ান আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, “সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আমরা ঘোর বিরোধী। ২০০৯-এ কন্ধমলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরেই আমরা বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে দিই। সেই থেকে দুই দল আলাদা চলেছি। কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা গেলে আমাদের প্রশাসন দ্রুত তা প্রশমনে এগিয়ে যায়। এ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কখনও পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠেনি।”
পান্ডিয়ানকে প্রশ্ন করা হয়, কংগ্রেস বলছে— সে ভাবে বিজেপির বিরোধিতা করে না বিজেডি, বরং সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে বিজেপির সুবিধাই করে দেয় তারা। তাদের এই অভিযোগ কি ভুল? পান্ডিয়ানের কথায়, “নবীনবাবুই সবার আগে ঘোষণা করেছিলেন, ওড়িশায় এনআরসি বাস্তবায়ন করা হবে না। তিনি এখনও এই প্রশ্নে একই রকম অনড়। তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরও আমরা বিরোধী।” বিজেডি-র এই নেতার কথায়— তাঁরা অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী। এই বিষয়ে সমঝোতার প্রশ্ন নেই। বিজেডি সরকারের আমলে মন্দিরের পাশাপাশি সরকারি বরাদ্দে রাজ্যের সব মসজিদ ও গির্জারও সংস্কার করা হয়েছে। পান্ডিয়ান বলেন, “বিজেডি সভ্য-ভদ্র রাজনীতির ধারায় বিশ্বাসী। উচ্চকণ্ঠে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, অপশব্দ প্রয়োগকে আমরা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি। তাই হয়তো বিপক্ষ অন্য কথা বলেন।”
নির্বাচনে বিজেপি তাঁদের প্রতিপক্ষ হলেও কয়েক মাস আগে তাদের সঙ্গে জোট গড়ার জন্য আলোচনা শুরু করেছিল বিজেডি। পান্ডিয়ানের ব্যাখ্যা, “জোটের ভাবনাটি ছিল দু’জন নেতার বন্ধুত্বের আবদার। এর মধ্যে রাজনীতি বিশেষ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক বন্ধু। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব ছিল, লোকসভা নির্বাচনে পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে আমরা যদি এগোতে পারি। আমাদের মনে হয়েছিল, এটা হলে রাজ্যের উন্নয়নের কাজে গতি আসতে পারে। কিন্তু আলোচনা শুরুর পরে খুব সদর্থক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলাম না। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যে উৎসাহেও ভাটা ছিল। ফলে আলোচনার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে বিজেডি।”
গত কয়েক বার লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একসঙ্গে হচ্ছে ওড়িশায়। দেখা যায়, বহু মানুষ বিধানসভায় আপনাদের ‘শঙ্খ’ চিহ্নে ভোট দিলেও কেন্দ্রে তাঁদের পছন্দ বিজেপির ‘পদ্ম’। এটা কি বিজেডির অবস্থান নিয়ে এই ধন্দেরই প্রতিফলন?
পান্ডিয়ান বলেন, “দেখা যাচ্ছে, বিধানসভার থেকে লোকসভায় আমরা ৫ থেকে ৬ শতাংশ কম ভোট পাই। তাই এ বিষয়ে আলাদা জোর দিয়েছি আমরা। বিশেষ প্রচারও করা হচ্ছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জোড়ী শঙ্খ’। বিধানসভা ও লোকসভা দু’ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য আবেদন করা হচ্ছে ‘জোড়ী শঙ্খ’-এ। কারণ, শুধু ভোটে জেতা নয়, আমাদের লক্ষ্য ২০৩৬— ওড়িশা রাজ্যের শতবর্ষ। এই সময়ের মধ্যে ওড়িশাকে সর্ব ক্ষেত্রে দেশের প্রথম সারিতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।” বিজেডি-র এই নেতা জানান, প্রতি বছর বাজেট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা করে এ জন্য সরিয়ে রাখা হচ্ছে। যে যে ক্ষেত্রে রাজ্যের উন্নয়নের গতিকে ত্বরাণ্বিত করা প্রয়োজন, সেখানে অর্থের প্রয়োজন মেটাবে এই সরিয়ে রাখা অর্থ।
পান্ডিয়ান বলেন, “সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে শিক্ষায়। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন— জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক মানের ওড়িশা গঠন করতে হবে। সেটা যেমন শিক্ষায়, তেমনই স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, পরিবহণ, নগরায়ন, পর্যটন— প্রতিটি ক্ষেত্রে। শিক্ষার পরে জীবিকার জন্য প্রস্তুত করতে হবে আমাদের যুবকদের। এ জন্য ‘দক্ষতা উন্নয়ন’-এর পৃথক পরিকাঠামো তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সরিয়ে রাখা ১০ হাজার কোটির মধ্যে আবার বছরে ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হবে রাজ্যের তরুণদের মতামত নিয়ে। অর্থাৎ, তাঁদের অধিকাংশ যা চান, সেই কাজে এই হাজার কোটি টাকা খরচ করবে রাজ্য। যেমন, পড়ুয়াদের জন্য বই কিনতে ভর্তুকি চাইলে সরকার পড়ুয়াদের জন্য মূল্যছাড়ে বই কেনার ব্যবস্থা করবে। বা অন্য কিছু।”
প্রশ্ন করা হয়— “এত ভর্তুকির কথা, পরিকাঠামোয় এত বরাদ্দ। রাজ্যের আয় না বাড়লে তো সবই কথার কথা থেকে যাবে। সে জন্য শিল্প স্থাপন জরুরি। কী পরিকল্পনা বিজেডি-র?” পান্ডিয়ানের জবাব, “ঋণের সঙ্গে রাজস্ব আয়ের অনুপাতে দেশের মধ্যে সবার আগে ওড়িশা। গত কয়েক বছর ধরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সব চেয়ে বেশি এসেছে ওড়িশায়। ওড়িশা আজ নির্মাণ শিল্পে দেশে পয়লা নম্বরে। অজস্র তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প আসছে ওড়িশায়। বহুজাতিক আর্সেলর-নিপ্পন দেশের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানাটি নির্মাণ করছে আমাদের রাজ্যে। ওয়েলস্পান গোষ্ঠী মস্ত পোশাক কারখানা তৈরি করছে। ওড়িশা আইনশৃঙ্খলায় যেমন এগিয়ে, রাজনৈতিক অস্থিরতাও এখানে নেই। দেশি-বিদেশি সংস্থার পছন্দের গন্তব্য তাই এখন ওড়িশা।” তাঁর সংযোজন, “রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সুষ্ঠু ভাবে রাজ্যের সব শ্রেণির মানুষের কাছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়াও বিজেডি সরকারের অগ্রাধিকার।”
তবে সরকারি কাজের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির বিষয়টি জড়িত। আর বিজেডি সরকারের বিরুদ্ধেও উঠছে বেশ কিছু দুর্নীতির অভিযোগ। বারো বছর মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করা পান্ডিয়ানের কথায়, “দুর্নীতি ঘটে সরকারি অফিসারদের দায়বদ্ধতার অভাব থেকে। রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা সেই সুযোগ নেন। তবে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ওড়িশায় দুর্নীতির জন্য যত জন প্রথম সারির সরকারি অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, আর কোনও রাজ্যে হয়নি।” বিজেডি-র এই নেতা বলেন, “নীতিও পরিবর্তন করেছি আমরা। প্রাকৃতিক সম্পদের খনিগুলি আগে কিছু বাছাই করা লোকেদের দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হত। এর ফলে দুর্নীতির সুযোগ থাকত। অন্য সব রাজ্যে এখনও সেটাই করা হয়। আমরা পদ্ধতি বদলে টেন্ডারের ব্যবস্থা করেছি। তার পরে এই খাতে সরকারের আয় বেড়ে গিয়েছে ১০ গুণ, ৫ হাজার কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকায়।”
তাঁকে নিয়ে তো বিরোধীদের অভিযোগ রয়েছে— ভিন্ রাজ্যের মানুষ হওয়ায় পান্ডিয়ানের সঙ্গে ওড়িয়া অস্মিতা, সংস্কৃতির যোগ নেই। পান্ডিয়ান হেসে বলেন, “আমি তামিলনাড়ুর মানুষ, ওড়িশায় আমলা হয়ে কাজে এসেছিলাম। তার পরে বহু সঙ্কটের দিনে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে কাজ করে আমি অভিভূত। এমন মানুষ রাজনীতিতে খুব দরকার। বাহানাগায় ট্রেন দুর্ঘটনার সময়ে সারা রাত তাঁর দফতরে কাজ করেছি। আমাদের জন্য তিনি খাবারের ব্যবস্থা করলেন, তাড়া দিয়ে সকলকে খাইয়ে দিলেন। দেখলাম নিজে কিছু খেলেন না। জানতে চাওয়ায় বললেন, “এত মৃত্যুর পরে আজ আমার মুখে কিছু উঠবে না। ঘুমও আসবে না।” তিনি যখন ২০৩৬-এর মিশনের জন্য আমাকে বাছলেন, আমি চাকরি ছেড়ে দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।” পান্ডিয়ানের কথায়, “বিপক্ষ যাই বলুন, ওড়িশার মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছেন। আমাকে দেখে ভিড় জমান তাঁরা, উল্লাস করেন। কেন? আমি তো চিত্রতারকা নই, ক্রিকেট তারকাও নই। মুখ্যমন্ত্রীর মিশন রূপায়ণ করছি মাত্র।”
নবীনবাবুর পরে ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ানই কি তা হলে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী? জবাব এল, ‘‘আরও বেশি আসন নিয়ে বিজেডি ওড়িশার সরকারে ফিরবে আর মুখ্যমন্ত্রী হবেন নবীন পট্টনায়ক।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy