(বাঁ দিক থেকে) পরাকলা প্রভাকর, নরেন্দ্র মোদী, নির্মলা সীতারামন। —ফাইল চিত্র।
দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের অর্থনীতিবিদ স্বামী পরাকলা প্রভাকর নির্বাচনী বন্ড নিয়ে বুধবার যে মন্তব্য করেছেন, তাকে অনেকেই বলছেন ভোটের মুখে ‘বিস্ফোরণ’। তার পর স্বয়ং নির্মলার বক্তব্যও আলোড়িত করেছে রাজনৈতিক মহল এবং বিজেপিকে। উপর্যুপরি ওই ঘটনার পর অনেকেই বলছেন, নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালের এক দশকে ভিতর থেকে এই ধরনের ‘ফোঁস’ কখনও শোনা যায়নি। সময়ের নিরিখেই প্রভাকর এবং নির্মলার বক্তব্যকে জুড়ে দেখতে চাইছেন অনেকে। বিজেপি নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, ভোটের মুখে নির্মলা এবং তাঁর স্বামীর বক্তব্য দলের জন্য ‘অস্বস্তিকর’। বিরোধী শিবিরের নেতাদেরও বক্তব্য, অর্থমন্ত্রীর স্বামী যে ভাবে মোদী সরকারের দিকে দুর্নীতির আঙুল তুলেছেন এবং খোদ অর্থমন্ত্রী যে ভাবে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়াবেন না বলেছেন, তার মধ্যে একটা দায় ঝেড়ে ফেলা বা সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যা মোদী জমানায় কখনও হয়নি।
নির্মলার স্বামী অতীতেও নরেন্দ্র মোদী সরকারের একাধিক আর্থিক নীতির সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু কখনও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেননি। বুধবার তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা সকলে দেখতে পেয়েছেন। সকলে এটি বুঝতে পেরেছেন, এটি শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ব়ড় দুর্নীতি। এটা বিজেপিকে ভোগাবে বলেই মনে হয়। এই দুর্নীতির কারণে কেন্দ্রের বর্তমান সরকারকে ভোটারেরা শাস্তি দেবেন।’’
এর পরেই জানা যায়, একটি বেসরকারি অনুষ্ঠানে লোকসভা ভোটে না দাঁড়ানো নিয়ে মন্তব্য করেছেন নির্মলা। তিনি জানান, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা তাঁকে অন্ধ্রপ্রদেশ কিংবা তামিলনাড়ু থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটে লড়ার ‘যথেষ্ট টাকা নেই’, এই যুক্তি দিয়ে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। লোকসভা ভোটে লড়ার প্রস্তাব পাওয়ার পর তিনি কী করেছিলেন, সে কথা জানিয়ে নির্মলা বলেন, “আমি এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন সময় নিয়েছিলাম। তার পর শুধু বললাম, না, (নির্বাচনে) লড়ার মতো টাকা আমার নেই।’’ প্রসঙ্গত, নির্মলা এখন রাজ্যসভার সাংসদ।
তথ্য বলছে, নির্বাচনী বন্ডের বিষয়টি শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন অধুনাপ্রয়াত অরুণ জেটলি। রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, বন্ড নিয়ে নির্মলার স্বামী যা বলেছেন, তার মধ্যে ‘অন্তর্নিহিত বার্তা’ও রয়েছে। তিনি এ-ও বুঝিয়ে চেয়ে থাকতে পারেন যে, যাকে তিনি ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি’ বলে অভিহিত করেছেন, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল অর্থমন্ত্রী জেটলির আমলে। স্বামী বলেছেন, বন্ড নিয়ে ভোটে ভুগতে হবে বিজেপিকে। তার পরে নির্মলা বলেছেন, তিনি লোকসভায় দাঁড়াবেন না। এই দুই বক্তব্যকে জুড়ে দেখতে এবং দেখাতে চাইছেন অনেকে। তা ছাড়া অনেকের এ-ও বক্তব্য, অর্থসঙ্কটের জন্য ভোটে না দাঁড়ানোর যে যুক্তি নির্মলা দিয়েছেন, তা কতটা পোক্ত তা নিয়েও অনেকেই সংশয়ী। রাজ্য বিজেপির এক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, ‘‘ভোটে লড়ার টাকা তো দল দেয়। এটা খুবই ছেঁদো কথা হয়ে গিয়েছে!’’
বাবুল সুপ্রিয় মোদী মন্ত্রিসভায় পদ খোয়ানোর কয়েক মাস পরে তৃণমূলে যোগ দিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিত্বে থাকা অবস্থায় কেউ তা করেননি। কোনও মন্ত্রীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ বৃত্তেরও কেউ এই ধরনের অভিযোগ তোলেননি, যা নির্মলার স্বামী বলেছেন। এর আগে রাফাল, পিএম কেয়ার্স ফান্ড নিয়ে বিরোধীরা দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী বন্ডের মতো ঘটনা ঘটেনি। এতে প্রথমে সুপ্রিম কোর্ট আর তার পরে বিরোধীদের সমালোচনা বিজেপিকে ‘বিড়ম্বিত’ করছে বলেই অভিমত অনেকের। রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ী অবশ্য নির্মলার লোকসভা ভোটে না দাঁড়ানো বা তাঁর স্বামীর বক্তব্যকে দলের জন্য ‘অস্বস্তিকর’ বলে মানতে চাননি। তবে রাজনাথ সিংহের ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করতেন। কিন্তু মোদী জমানায় সবটাই ছকে বাঁধা। ব্যক্তিগত মত প্রকাশ্যে বলেন না কেউ। রাজ্য স্তরে কোনও নেতা বা মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলে বা করে বসলে দল ব্যবস্থা নেয়। সে দিক থেকে নির্মলার বক্তব্য ব্যতিক্রমীই বটে।’’
পক্ষান্তরে, তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘নির্মলা সীতারামনের স্বামী যা বলেছেন, তাতে তো এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ইডি সব জেনেও চুপ ছিল! এ ক্ষেত্রে কোথায় গেল কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ভূমিকা? তাতে তো দায় রয়েছে অর্থমন্ত্রী নির্মলারও।’’ তবে কুণালও মানছেন, মোদীর ঘরের ভিতর থেকে এই প্রথম বিরুদ্ধস্বর শোনা গেল। এবং তা ভোটের আগে।
বামদলগুলি নির্বাচনী বন্ড গ্রহণ করেনি। তাদের মধ্যে সিপিএম অন্যতম। নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যত মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে, তার আবেদনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, ‘‘নির্মলার কথার মধ্যে একটা সরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁর স্বামী যে অভিযোগ করেছেন, তা আমরাই গোড়া থেকে বলে আসছিলাম। এখন হয়তো ওঁরাও বুঝতে পারছেন, মোদীর নামে যে ঢক্কানিনাদ হচ্ছে, তার বাস্তব ভিত্তি নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy