Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

বারামতীতে শরদের আবেগের সঙ্গে যুদ্ধ অজিতের কর্মযজ্ঞের

গর্জন উঠছে জনসভা থেকে, ‘রাম কৃষ্ণ হরি, বাজবা তুতারি’! সেই স্লোগান লোকমুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে আখের খেতে, আঙুরের সাম্রাজ্যে, বয়স্ক মানুষের থরহরি আবেগে।

(বাঁ দিকে) শরদ পওয়ার এবং (ডান দিকে) অজিত পওয়ার। —ফাইল চিত্র।

(বাঁ দিকে) শরদ পওয়ার এবং (ডান দিকে) অজিত পওয়ার। —ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
বারামতী শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৪ ০৯:২৩
Share: Save:

‘তাই’ বনাম ‘বহিনির’ লড়াই। আবেগ বনাম অঙ্কের যুদ্ধ। 'সাহেব' বনাম 'দাদা'-র সংঘাত। শহরের সঙ্গে গ্রামের বিরোধ। নাকি যুবাশক্তির সঙ্গে প্রবীণতন্ত্রের সম্মুখসমর?

যে ভাবেই দেখা যাক না কেন, পুণে থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে পওয়ার পরিবারের খাসতালুক বারামতীর পারিবারিক মহানাটকটিকে এ বারের লোকসভা ভোটে দেশের সবচেয়ে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের তালিকায় রাখা হচ্ছে।

গর্জন উঠছে জনসভা থেকে, ‘রাম কৃষ্ণ হরি, বাজবা তুতারি’! সেই স্লোগান লোকমুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে আখের খেতে, আঙুরের সাম্রাজ্যে, বয়স্ক মানুষের থরহরি আবেগে। মহারাষ্ট্রে রাজরাজড়াদের বাদ্যযন্ত্র ‘তুতারি’ (ট্রাম্পেট-এর মরাঠি সংস্করণ)-কেই নতুন প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সাহেব অর্থাৎ শরদ পওয়ার। যিনি সেই ১৯৬৭ থেকে এখানকার একচ্ছত্র নেতা। অন্য দিকে 'দাদা' অর্থাৎ শরদের ভাইপো, অজিত পওয়ার বারামতীকে ঘিরে তাঁর কাজের যে খতিয়ান দিয়েছেন, তাতে উদ্দীপ্ত শহরকেন্দ্রিক যুবক, পেশাদারেরা। তাঁদের সম্মিলিত মত, দাদা বদলে দিয়েছেন বারামতীকে। বহুজাতিক ব্র্যান্ডের মেলা বসিয়েছেন। বিমানবন্দরসদৃশ বাস স্ট্যান্ড বানিয়েছেন। এমন এক পেশাদারি শিক্ষাতালুক তৈরি করেছেন, যেখানে পুণে থেকেও অনেকে পড়তে আসছেন।

শরদের কন্যা সুপ্রিয়া সুলের সঙ্গে এই কেন্দ্রে কাঁটার লড়াই অজিতের স্ত্রী সুনেত্রার। পুণে থেকে জেসুর মরগাও রোড ধরে, আখ খেতের মাঝে আলো পিছলানো রাস্তায় বারামতী নির্বাচনী ক্ষেত্রের দিকে এগোলেই টের পাওয়া যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে কী বিরাট পরিবর্তন হয়েছে পরিবেশের। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ফ্রেমে, পাহাড়ি পথে একের পর এক ‘মিশাল’ (এখনকার সুপারহিট খাদ্য, পাওভাজি আর চাটের সংমিশ্রণ) সেন্টার। তাদের নামও বাহারি। যেমন ‘অস্কারওয়াড়ে মিশাল সেন্টার’! এক কোণে খাচ্ছিলেন ভাস্কর জারদওয়াডে়। পাশে বসে ভোটের কথা তুলতেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন পেশায় কৃষক ভাস্কর। ঘোলাটে চোখে তাঁর আবেগ, ‘মাতারা’কে (বৃদ্ধ) তাঁরা ছাড়বেন না। “আমাদের গ্রামের যৌথ পরিবারের সংস্কৃতি, কেউ বৃদ্ধ হলে তাঁকে আরও বেশি সম্মান করতে হয়, আগলে রাখতে হয়। সাহেবকে ওর ভাইপো এ ভাবে ছেড়ে গিয়ে ভাল কাজ করেনি। দাদা আমাদের ভোট নিয়ে বিজেপিতে চলে গেছে, এটা ঠিক নয়। মঙ্গলবারের ভোটে সবাই এর জবাব দেবে। সাহেব আমাদের অনেক দিয়েছেন, শিখিয়েছেন। সুপ্রিয়া তাইকেই আমরা ভোট দেব তুতারি চিহ্নে।”

পওয়ারকে নিয়ে এই আবেগ শুধু ভাস্কর নয়, এই নির্বাচনী ক্ষেত্রের চল্লিশোর্ধদের (প্রধানত কৃষক সম্প্রদায়ের) মধ্যে প্রবল ভাবে সঞ্চারিত। পওয়ারপন্থী এনসিপি-র পুণে শহরের সভাপতি প্রশান্ত জগতাপ বলছেন, "সাহেবকে নিয়ে এই আবেগের তরঙ্গ যদি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে, সুপ্রিয়া দু’লাখের বেশি ভোটে জিতবেন।"

কিন্তু আবেগ শেষ কথা বলে কি? গত দশ বছর সাহেব নিজেই তো কন্যা সুপ্রিয়াকে দিল্লির দায়িত্ব দিয়ে অজিতকে ছেড়ে দিয়েছিলেন বারামতীর রাজ্যপাট। আর সেই সুযোগে অজিত বারামতী শহরকে একটি পাঁচতারা শহর বানিয়ে ছেড়েছেন। যা ঘুরে দেখে চোখ বিস্ফারিত হওয়ার জোগাড়। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যানালের সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে মহাযজ্ঞের মতো করে। ওয়েস্টমিনস্টারের বিগ বেনের আদলে বসানো হয়েছে পেল্লায় ঘড়িস্তম্ভ, ক্যানালের পাশে কফি শপ, জগার্স পার্ক, বিনোদন পার্ক— কি নেই! রাজ্য সরকারের অর্থে নগর পরিষদ দিল্লি হাই কোর্টের আদলে বানিয়েছে জেলা আদালত, পুরনো সংসদ ভবনের ধাঁচে পঞ্চায়েত সমিতির অফিস। বিমানবন্দরের লাউঞ্জের মতো সুবিশাল এক বাসস্ট্যান্ড, যেটির কথা শুনেছি মহারাষ্ট্রে পা দিয়েই। “দাদা ভোর ছ’টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করেন, এটা মিথ্যে নয়। আমরা নিজের চোখে দেখেছি, মাঝরাতে এসে তদারকি করতে এই বাস স্ট্যান্ডের কাজের।’’ জানালেন ভিট্টল দেহিগড়ি, যিনি এই কমপ্লেক্সে মাসিক ২৩ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি খাবারের দোকান পেয়েছেন। প্রায় ১ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়েন বারামতীর শহরাঞ্চলে। কারিগরি প্রশিক্ষণ থেকে হালে হওয়া এআই-কেন্দ্র, বিমান চালকদের প্রশিক্ষণ, আইন, শিল্প, স্থাপত্য সব কিছুরই প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তৈরি হয়েছে সাত তলা মেডিক্যাল কলেজ। সব মিলিয়ে পরিষেবার সুযোগ এবং চাকরি বেড়েছে। বহুজাতিক ব্র্যান্ড উপচে পড়েছে রাস্তার দু পাশে।

তবে এই উন্নয়ন মূলত শহরকেন্দ্রিক। বারামতী বিধানসভা এবং বারামতী শহরকে ঘিরে। তার বাইরে বারামতীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শ'চারেক গ্রাম, সেখানকার ছোট চাষিদের জলের কষ্টের সুরাহা উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েও সামলাতে পারেননি অজিত। "২০০৪ থেকে ২০১৪— এই দশ বছরে আমাদের কৃষি সমস্যা মেটাতে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাহেব। তিনি তখন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী। সিরসাই লেক তো সাহেবের সময় তৈরি, এখনও যার সুফল পাচ্ছি আমরা। তাঁর জন্যই বারামতীতে কৃষক আত্মহত্যার খবর শুনবেন না। তবে রোজকার ব্যবহারের জন্য সরকারের কাছ থেকে এখন ট্যাঙ্কের জল পেলেও চাষের জন্য পাচ্ছি না আমরা গত দশ বছর। এ বারে সাহেব এসে আমাদের কথা দিয়ে গিয়েছেন, কেন্দ্রে তাঁদের সরকার এলে জলের সমস্যা একেবারেই ঘুচিয়ে দেবেন,” জানাচ্ছেন বারামতী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম জরাদওয়াড়ির কৃষক আকাশ কাচাড়ে।

শরদ এই বারামতী থেকে টানা ছ’বার বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছেন। লোকসভা নির্বাচনে জিতেছেন টানা পাঁচ বার। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কন্যা সুপ্রিয়াকে নিজের এই আসনটি ছেড়ে দিয়েছিলেন শরদ। তার পর থেকে টানা তিন বার লোকসভা ভোটে সুপ্রিয়াই জিতেছেন এই আসনে। কিন্তু সমস্যা হল এসেছেন, জিতে আবার দিল্লি ফিরে গিয়েছেন সুপ্রিয়া। শরদের নির্দেশে গত দশ বছর বারামতী সামলেছেন এখানকার বিধানসভা থেকে সাত বার জেতা অজিত। তাঁর স্ত্রী সুনেত্রা নিজেও রাজনৈতিক পরিবারের কন্যা। তাঁর ভাই পদ্মসিংহ পাটিল মহারাষ্ট্রেরই প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী। যদিও বড় জনসভায় ঝড় তোলার ক্ষমতা না থাকায় সুনেত্রা লড়ছেন স্বামীর ছায়া হিসাবে। ছোট ছোট সভা করছেন, ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন।

তবে আসল লড়াইটা যে সাহেবের সঙ্গে দাদার, তা স্পষ্ট। সুপ্রিয়া হেরে গেলে ভারতীয় রাজনীতি তথা এনসিপি-র ইতিহাসে শরদ যাত্রা শেষ করবেন। আর অজিত যদি
সুনেত্রাকে না জেতাতে পারেন, তা হলে আগামী দিনে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন তাঁর কতটা পূরণ হবে, সন্দেহ রয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Baramati Spot Reporting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy