ধুম! সাতসকালে সল্টলেকের রাস্তায়! সেই বাইক। সেই পুলিশ। এবং সেই... পরিচিত দৃশ্যের ধারকাছ দিয়ে যাওয়া আশ্চর্য এক চিত্রনাট্য যেন এক! ছিল ক্যামেরাও। তবে কি ধুম ফোর! ধুম এক থেকে তিন, সব ক’টাতেই বাইকের মাস্তানিতে চোর-পুলিশের রোমহর্ষক সেই ‘চেজ গেম’গুলির কথাই মনে করিয়ে দিল সোমবারের সল্টলেক। সফল চিত্রনাট্যের খুঁটিনাটি মেনেই সিজিও কমপ্লেক্সে পুলিশের বাইকে চেপে, চাদর মুড়ি দিয়ে এলেন তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক শঙ্কুদেব পণ্ডা। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রায় একই রকম ভাবে বেরিয়েও গেলেন তিনি। তবে এ বার আর বাইক নয়, নিজের এসইউভি চেপে।
মূল রাস্তা থেকে ঘুরে গিয়ে দু’পাশের অফিসবাড়ির ভেতর দিয়ে যে পথ সোজা সিজিও কমপ্লেক্সের লিফট বারান্দায় ধাক্কা খেয়েছে, লম্বায় সেটি মেরেকেটে ১০০ মিটার হবে! সকালবেলায় সে পথের আশেপাশে পুলিশ-সংবাদমাধ্যম-অফিসকর্মী মিলিয়ে জনা চল্লিশেক মানুষ ইতিউতি ছড়িয়ে। প্রেক্ষাপট বলতে এটুকুই।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক ১১টা বেজে ২৫। মূল রাস্তা থেকে সিজিও-র ওই পথে ঢুকে পড়ল একটি বাইক। গতিবেগ ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটারের আশপাশ। পুলিশের স্টিকার লাগানো ওই বাইকে চালক-আরোহী মিলিয়ে তিনজন। চালকের মাথায় লাল হেলমেট। মাঝের জনের মুখ গায়ের কালো চাদরে জড়ানো। পিছনে বসা আরোহীর মাথা একেবারে খালি। চাদরের ফাঁক দিয়ে মাঝের জনের মুখের একাংশ বা বলা ভাল চোখ দু’টিই শুধু দেখা যাচ্ছে। পথের ধারে অপেক্ষায় থাকা সংবাদ মাধ্যম তত ক্ষণে শশব্যস্ত, যদি গায়ে এসে পড়ে!
কিন্তু, দক্ষ চালক তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন লিফটের সামনে। বাইক থেকে নেমে পড়লেন মাঝের আরোহী। লিফটের দিকে দৌড়ে গেলেন। চাদর মুখ থেকে সরে গেল। তবে, সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কেউ কেউ সন্দেহ করেছিলেন। তাই, বাইক থামামাত্রই তাঁরাও দৌড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন লিফটের কাছে। ক্যামেরার ফ্লাশবাল্বের একের পর এক ঝলকানি, ভিডিও ক্যামেরার রেকর্ডিং-এর মাঝেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ সেই লিফটে করে সিজিও কমপ্লেক্সের সাত তলায় ইডি-র দফতরে এ ভাবেই পৌঁছলেন তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক শঙ্কুদেব পণ্ডা। কালো চাদরে মোড়া ওই বাইক আরোহীর চোখ দেখে সন্দেহ হওয়ায় যাঁরা ক্যামেরা নিয়ে দৌড়েছিলেন লিফটের দিকে, তাঁদের মুখে তখন শুধুই আফশোসের কথা। এ সবের মধ্যেই বাইক আরোহী সেই একই গতিতে সিজিও কমপ্লেক্স ছেড়ে ধাঁ। শঙ্কু তত ক্ষণে বাইকের পিছনের আরোহীকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন সাত তলায়।
কিন্তু হঠাত্ এ ভাবে চিত্রনাট্য সাজিয়ে ইডির দফতরে এলেন কেন শঙ্কু? সংবাদমাধ্যমকে এড়াতে? পুলিশের স্টিকার লাগানো বাইক কে চালাচ্ছিলেন? কোনও পুলিশকর্মী? নাকি তৃণমূলেরই কোনও কর্মী? এ সবের মধ্যেই বাইক আরোহীর ওই একই গতিতে চলে যাওয়া নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই সিজিও কমপ্লেক্সে ঢোকে শঙ্কুদেব পণ্ডার নিজের গাড়িটি। কোথায় ছিল এটি এত ক্ষণ? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে থাকলেও কোনও উত্তর মেলেনি। যেমন, লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে শঙ্কুর উদ্দেশে ছোড়া প্রশ্নগুলোরও কোনও উত্তর মেলেনি। শঙ্কু ঢোকার মিনিট দশেক আগেই সিজিও কমপ্লেক্সে এ দিন পৌঁছন ‘কলম’ পত্রিকার এক সময়ের মুদ্রক ও প্রকাশক আমিনউদ্দিন সিদ্দিকী। বেলা ১১টা ১৫ নাগাদ তিনি সিবিআই দফতরে আসেন।
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে গত ২৩ ডিসেম্বর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) শঙ্কুকে ডেকে পাঠায়। তাঁকে ৩০ তারিখ মঙ্গলবার দেখা করতে বলা হয়। তবে, নির্ধারিত দিনের এক দিন আগেই কেন শঙ্কু ইডি-র দফতরে এলেন তা নিয়েও ধন্দ রয়েছে। সারদা-র একটি চ্যানেলে উচ্চপদে কাজ করতেন তিনি। মোটা বেতনের পাশাপাশি সর্ব ক্ষণ ব্যবহারের জন্য তিনি একটি গাড়িও পেতেন কোম্পানি থেকে। পরে শুভাপ্রসন্নের চালু না হওয়া একটি চ্যানেলেও কাজ করেন শঙ্কু। ওই চ্যানেলটিও পরে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন কিনে নেন। তার পরে চ্যানেলের কর্তা হিসেবে মাসের পর মাস বেতন নিয়েছেন শঙ্কু। সেই টাকাও সারদার অ্যাকাউন্ট থেকেই যেত। বেতন ছাড়াও তিনি আরও বহু টাকা নগদে বা চেকে বেশ কয়েক বার নিয়েছেন। কিন্তু কেন? সেটা জানতেই তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর।
ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রবল ধস্তাধস্তির মধ্যে বিকেল তিনটে নাগাদ শঙ্কুদেব বেরিয়েও গেলেন। চার দিকে তখন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ভেতর দিয়ে যে ভাবে তাঁর এসইউভি-টি সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে যায়, তাতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন সেখানে হাজির সকলে। যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারত বলে তাঁদের মত। কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেননি তৃণমূলের এই অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। যেমন নাটকীয় ভাবে এসেছিলেন শঙ্কু, ঠিক তেমন ভাবে বেরিয়েও গেলেন তিনি। পুরোটাই যেন রহস্যে মোড়া এক চিত্রনাট্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy