প্রতীকী চিত্র।
২০২৪-র শেষ সপ্তাহে রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল ‘ক্রেডিট বেসড সিমেস্টার সিস্টেম’ (সিমেস্টার) পদ্ধতিতে পঠনপাঠনের কথা। কিন্তু নতুন বছর পড়তেই সেই পদ্ধতিকে সরাসরি বাতিল ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কী ছিল ক্রেডিট বেসড সিমেস্টার সিস্টেম পদ্ধতিতে? তা চালু হলে কী প্রভাব পড়ত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায়?
নতুন সিমেস্টার পদ্ধতি ঘোষণা হয়েছিল কিছু দিন আগেই। পর্ষদের তরফে জানানো হয়েছিল, আগে বছরে এক বারই পরীক্ষা নেওয়া হত। সেই পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে পড়ুয়াদের পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার ব্যবস্থা ছিল। তবে সিমেস্টার পদ্ধতি চালু হলে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দু’ভাগে ভাগ করা হত। জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর— গোটা বছরকে এই দু’ভাগে ভাগ করে পরীক্ষা নেওয়া হত। প্রথম সিমেস্টার হত ৪০ নম্বরে। পরের পরীক্ষা হত ৬০ নম্বরে।
৪০ নম্বরের পরীক্ষা লিখিত আকারে হত না। ৪০ নম্বরের মধ্যে ২০ নম্বর পড়ুয়াদের উপস্থিতি, ক্লাসে আচরণ ইত্যাদি বিষয় মূল্যায়নের উপর। বাকি ২০ থাকত বিভিন্ন প্রজেক্টের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। দ্বিতীয় সিমেস্টার হত পুরোটাই লিখিত। তবে সেখানেও বদল আনা হয়েছিল। তাতে প্রশ্নপত্র তৈরি করার দায়িত্ব আর থাকত না স্কুলের হাতে। প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র তৈরি করত পর্ষদই। গোটা রাজ্যে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হত সে ক্ষেত্রে। তবে খাতা দেখতেন সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই।
পড়ুয়াদের জন্য থাকত ‘ক্রেডিট স্কোর’ও। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য প্রত্যেক বছর ক্লাসের মোট সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭৬ ঘণ্টা। তার উপর দেওয়া হত ‘ক্রেডিট স্কোর’। সর্বোচ্চ ‘ক্রেডিট স্কোর’ স্থির করা হয়েছিল ১৩.৫। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বছরে ক্লাস নেওয়া হত ৪৬০ ঘণ্টা। এই তিন শ্রেণির জন্য সর্বোচ্চ ‘ক্রেডিট স্কোর’ স্থির করা হয়েছিল ১৬.৫।
নতুন বছর পড়তেই মুখ্যমন্ত্রী এই ক্রেডিট বেসড সিমেস্টার সিস্টেমকেই পুরোপুরি বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই পদ্ধতি চালু হলে সমস্যা কোথায় হত?
পর্ষদ সূত্রে খবর, প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নেই পাশ-ফেল প্রথা। পড়ুয়াদের পড়াশোনার মূল্যায়নে রয়েছে মাস ভিত্তিক সামেটিভ পরীক্ষা ব্যবস্থা। একইসঙ্গে চলতি বছর থেকে চালু হতে চলেছে হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড। যার জন্য সরকারের তরফ থেকে ইতিমধ্যেই শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এমনকি রিপোর্ট কার্ড ছাপিয়ে চলেও এসেছে স্কুলগুলিতে। এমতবস্থায়, নয়া সিমেস্টার পদ্ধতির সঙ্গে এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডে মূল্যায়ন ব্যবস্থার বিস্তর ফারাক রয়েছে। একটি (সিমেস্টার) চালু হলে অপরটি (হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড)-র গুরুত্ব হারাত।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাঙুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় বড়ুয়া বলেন, ‘‘এক দিকে হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড নিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন। তার পরেই হঠাৎ করে শেষ বেলায় সিমেস্টার পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত। যার ফলে বিভ্রান্তিতে পড়েছিল স্কুলগুলি। এই ব্যবস্থা চালু হলে সমস্যায় পড়ত স্কুলগুলিই।’’
মুখ্যমন্ত্রীর সিমেস্টার বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি-র সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড অর্থাৎ সারা বছর ধরে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও সিমেস্টার দুটো ব্যবস্থা একসঙ্গে চলতে পারে না, সেটা আমরা আগেই বলেছিলাম। এতে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের উপর অহেতুক চাপ বেড়ে যেত। সেই পরিকাঠামোও ছিল না। সরকার প্রাথমিকে সিমেস্টার চালু করবে না বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সঠিক বলে আমরা মনে করি।’’
উল্লেখ্য, স্কুলের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নে নম্বর দেওয়ার পাশাপাশি এক জন পড়ুয়ার বৌদ্ধিক বিকাশ কতটা হচ্ছে, সেটাও যাচাই করতে হয় শিক্ষকদের। সেই মতামত তাঁদের লিখতে হবে হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডে। কোনও পড়ুয়া সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারছে কি না, সে কতটা মানসিক চাপ নিতে পারে, তার সাংগঠনিক, মতপ্রকাশ এবং কথোপকথনের দক্ষতা— সবই জানা যাবে হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড থেকে। সেই সঙ্গে এক জন পড়ুয়ার পছন্দের বিষয় থেকে শুরু করে সে কী নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় বেশি, তার সৃজনশীল দক্ষতাই বা কতটা-- সেই মূল্যায়নও শিক্ষকদের করতে হবে। এক কথায়, প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পাশাপাশি এক জন পড়ুয়ার অন্যান্য দিকে বিকাশ কতটা হয়েছে, তা-ই দেখা হবে এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডে।
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ-র সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলেন, ‘‘পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক, ভিত্তিহীন এবং পরিকল্পনা বহির্ভূত ভাবে প্রাথমিকে সিমেস্টার পদ্ধতি ঘোষণা করা হয়েছিল। যা নিয়ে শিক্ষামহল থেকে শুরু করে আমরাও প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকে যে টুকু শিক্ষা ব্যবস্থা আছে, সেটাও সঙ্কটের মুখে পড়ত।’’
শিক্ষামহলের একাংশ মনে করে, ভবিষ্যতে প্রাথমিকে সিমেস্টার প্রথা নয়, এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষক, প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষাকর্মী, কম্পিউটার, আকর্ষণীয় সিলেবাস, উন্নত পরিকাঠামো ও শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলতে পারলে তবেই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচানো যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy