পাঁচ হইতে সাত বৎসর বয়স্ক ৪০০ শিশু লইয়া এক সমীক্ষা করিয়া মার্কিন গবেষকরা দেখিলেন, তাহাদের মধ্যেও এই ধারণা ঢুকিয়া গিয়াছে: জন্মগত ভাবেই ছেলেরা মেয়েদের অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান। এই ধরনের পূর্বসংস্কার বা একধাঁচি অনড় ধারণা এই পুরুষশাসিত সমাজে বিরল নহে, কিন্তু এত কম বয়সে এইগুলি শিকড় গাড়িয়া বসে ও নারীদের হৃদয়ে পুরুষপ্রাধান্যের ঘটনাকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধের আকার দেয়, ইহা বিস্ময়ের। যে শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় নাই, তাহাদের মধ্যে অবশ্য এই ধারণা বড় একটা দেখা যায় নাই। সকল শিশুকে একটি ভারী বুদ্ধিমান ব্যক্তির গল্প বলা হইয়াছিল। তাহার পর তাহাদের চারিটি ছবি দেওয়া হয় ও বলা হয়, এই গল্পটি, ইহাদের মধ্যে কাহাকে লইয়া? দুইটি ছবি পুরুষের, দুইটি নারীর। যে শিশুরা বিদ্যালয়ে যায় নাই, তাহারা অধিকাংশই, নিজলিঙ্গের এক ব্যক্তিকে বাছিয়া লয়। কিন্তু স্কুল যাইতেছে এমন ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরাও, গল্পের প্রধান চরিত্র হিসাবে একটি পুরুষকেই বাছিয়া লয়। অর্থাৎ, যেই তাহার প্রথাগত শিক্ষা শুরু হইতেছে, যেই সে সমষ্টির মধ্যে গিয়া পড়িতেছে, তাহার মধ্যে এই বোধ ঢুকিয়া যাইতেছে যে, বুদ্ধিমান বলিয়া পরিচয় দেওয়া হইতেছে যখন, নির্ঘাত লোকটি পুরুষই হইবে।
ইহাতে সন্দেহ নাই যে জনমানসে এবং গণমাধ্যমে এই ধারণার সমর্থনের বন্যা বহিয়া যাইতেছে। যতই নারীরা বিমান চালান রকেট চালান রাষ্ট্রপ্রধানের পদ অলংকৃত করুন, বাঙালি মধ্যবিত্তও ‘লেডি ডাক্তার’ শুনিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে চাহেন, টিকিট কাটিবার লাইনে বিলম্ব হইলে কাউন্টারে মহিলা রহিয়াছেন দেখিয়া দ্বিগুণ চেঁচান, মার্কিন রাষ্ট্রপতিও নারীদের সম্পর্কে অপমানজনক উক্তি করেন। বিশ্বসাহিত্যে এত জন বিখ্যাত গোয়েন্দা রহিয়াছে, তাহাদের মধ্যে কয়জন নারী? দুর্গা গাছের ফল পাড়িতে অশেষ ডানপিটেমি করে, কিন্তু অপু নিজেকে মহাভারতের চরিত্র ভাবিয়া খেলা করে, তাহারই চক্ষে বিশ্বভুবন যেন নূতন করিয়া আবিষ্কৃত হয়। নিঃসন্দেহে ইহার একটি কারণ হইল, লেখকরা অধিকাংশই পুরুষ। কিন্তু লেখিকাও তো ধরাধামে খুব কম আসেন নাই। লীলা মজুমদারের প্রধান গল্পগুলির কেন্দ্রে দুষ্ট ছেলেই থাকে, মেয়ে নহে, সাম্প্রতিক অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় লেখিকাও তাঁহার কল্পকথার নায়ক করেন হ্যারি পটার নামক বালককেই, কোনও বালিকাকে নহে।
কিন্তু প্রবল আশঙ্কাজনক হইল এই তথ্য: এই সকল ধারণা শিশুদের স্কুলে ভর্তি হইবার প্রথম বা দ্বিতীয় বৎসরেই পাড়িয়া ফেলিতেছে। নিশ্চিত ভাবেই মার্কিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ধারণা প্রোথিত করিবার পরিকল্পিত অভিপ্রায়ে কোনও কার্য করা হয় না। তবু, কোন ব্যবহারগুলিতে, কোন কথাবার্তায় যে এই ধারণা-বীজ নিহিত রহিয়া যাইতেছে, তাহা সম্পর্কে নিশ্চয় প্রায় কেহই সচেতন নহেন— শিক্ষক-শিক্ষিকারা, অন্যান্য সহায়করা, পুং-সহপাঠীরা। এইখানেই বিপদটির গুরুত্ব প্রবল। অচেনা অসুখের মোকাবিলা করা অতি কঠিন। এই ধারণা অন্দরে ভিত্তি গাড়িলে, মেয়েরা জানিবে, তাহারা আর যাহাই হউক, প্রবল বুদ্ধিমান হইবে না, অলোকসামান্য প্রতিভা তাহাদের আয়ত্ত হইবে না। তাই তাহারা নূতন কাজের চেষ্টাই করিবে না, অভিনব প্রয়াসের ধারই মাড়াইবে না। ইহাতে পুংতন্ত্রের জাল আরও বিস্তৃত হইবে, এই বিকৃত ধারণাই ‘সত্য’ বলিয়া প্রমাণিত হইবে। অবিলম্বে সকলেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন, নিজ ব্যবহারের মধ্যে কোথায় লিঙ্গবৈষম্যের ইঙ্গিতগুলি রহিয়া গিয়াছে, কোথায় পুরুষদের প্রতি সমীহ ও পক্ষপাত বিকিরিত হইতেছে। সমগ্র সমাজেই ইহা প্রয়োজন, কিন্তু তাহা আশু ঘটিবে না। অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে এই আত্মসমীক্ষণের রেওয়াজ চালু হইলে, বালিকাগুলি গঠনকালটি মুক্তমস্তিষ্কে কাটাইতে পারে!
যৎকিঞ্চিৎ
ট্রাম্প প্রায় টি-টোয়েন্টি শুরু করেছেন। এই বাণিজ্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলেন, এই মেক্সিকোর পাশে পাঁচিল তোলার ভিত গড়ছেন, এই সাত-আটটা দেশের লোকের সামনে ‘প্রবেশ নিষেধ’ টাঙিয়ে দেওয়ার জোগাড়। ট্রাম্পের অভিষেকের দিনেই তাঁর বিরুদ্ধে যে মিছিল হয়েছে, তা প্রায় ষাটের দশকের ফ্ল্যাশব্যাক, ঢেউ উঠছে কারা টুটছে গোছের। এত কিছুর মধ্যে ট্রাম্পকে কুর্নিশ জানাতেই হয়, দেখা গেল অন্তত এক জন রাজনীতির কত্তা, প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তা রাখার চেষ্টা করেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy