এত দিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, এ বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় থাকছে না বাংলাদেশ। এ জিনিস ঘটবে প্রায় ত্রিশ বছর পর, ১৯৯৬ সাল থেকেই কলকাতা বইমেলার অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। মাঝখানে এতগুলি বছরে বইমেলা জায়গা পাল্টেছে, স্টল বেড়েছে অনেক, প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য আধুনিক প্রকরণ আত্মস্থ করে সে চরিত্রে হয়ে উঠেছে আরও আন্তর্জাতিক। এই আন্তর্জাতিকতার মধ্যে একটা চিরচেনা আন্তরিকতার স্পর্শ বয়ে আনত বাংলাদেশের বই, কলকাতা বলেই আরও— একই মাতৃভাষায় কথা বলা অথচ রাজনীতির ফেরে আলাদা ভূখণ্ডের বাঙালি যে আজও কেমন উদ্বেল পড়শি দেশের সাহিত্য, মননচর্চা ও এই সবেরই ধারক-বাহক বই নিয়ে, বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রতি বছর পাঠকের ঢল ছিল তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
এ বার যে দেখা যাবে না সেই ছবি, তার কারণটি রাজনৈতিক। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের জেরে উদ্ভূত পরিস্থিতিই এর কারণ, তার ছায়া পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতিতে। কূটনীতি সর্বদাই কঠোর রীতিনীতি ও আদবকায়দায় মোড়া এক গম্ভীর বিষয়, জনাবেগের ধার ধারে না। এই আবহে চলছে নানা কথার চালাচালি: বইমেলার আয়োজক পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড বলছে মেলায় বাংলাদেশের উপস্থিতি নিশ্চিত করায় তাদের হাত নেই, পুরোটাই নির্ভর করছে উপরমহল অর্থাৎ এ দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের উপর। আবার প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণ বিষয়ে গিল্ডকে জানানো হয় কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের তরফে, এ বছর তা হয়নি। অন্য দিকে, বাংলাদেশে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক জানিয়েছেন বাংলাদেশি প্রকাশকদের মেলায় আসার আগ্রহ ষোলো আনা, কিন্তু সাড়া মেলেনি ভারত থেকেই। এই বিভ্রান্তিতে হাওয়া দিচ্ছে সমাজমাধ্যমে দুই দেশের বাঙালির বাগ্যুদ্ধ, মেলায় বাংলাদেশের অনুপস্থিতি ঘিরে ডেকেছে বিদ্রুপ ও বিদ্বেষের বান।
কূটনৈতিক নীরবতা ও সমাজমাধ্যমের চিৎকৃত বচসা, এই দুইয়ের মাঝে ক্ষতিটি হল কার? সাদা চোখে দেখলে বাংলাদেশের প্রকাশনা ও বই-বণিকদের, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বিপুল বিক্রয়ের সুযোগটি রুদ্ধ হল। কিন্তু আর্থিক ক্ষতির ও-পারেও বাকি থাকে কিছু, তা একেবারে গোড়ার ক্ষতি। বইমেলা মানেই বিপুল বিচিত্র বইয়ের সম্ভার, এই মুহূর্তে একটি দেশের সাহিত্য, সমাজ, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে লেখক-চিন্তকরা যা ভাবছেন, তার ঘনীভূত গ্রন্থরূপ। এই সময়ে পদ্মাপারে বাংলা ও বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কোন গবেষণা হচ্ছে, কেমন চলছে অনুবাদকাজ, বিশ্ব ও বাংলার ইতিহাস সমাজতত্ত্ব অর্থনীতি নিয়েই বা কী ভাবছেন লেখকেরা, পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতির কোন দিগন্ত খুলে গেল, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে এক ছাদের তলায় সেই খোঁজ পেতেন এ-পারের আগ্রহী পাঠক। সমাজমাধ্যমে খড়্গহস্তরা আর যা-ই হোন প্রকৃত পাঠক নন, নইলে বই ও বইমেলাকে ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার উদারতাটুকু তাঁরা দেখাতেন। অস্থির সময়ে উস্কানিও প্রবল হয়, প্রয়োজন ছিল বই ও মননের চর্চা দিয়েই তাকে প্রশমিত করা, বাঙালির এত দিনের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সেতুটি পোক্ত করা। বইমেলায় বাংলাদেশের অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দেবে, সেই সুযোগটি হেলায় হারাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy