‘আপনি থাকলে অসুবিধে হচ্ছে।’ মাখড়া, ২ নভেম্বর। ছবি সৌজন্য: এবিপি আনন্দ
পুলিশ অফিসার এসে বললেন, ‘আপনি কথা বলবেন না। আসুন।’ প্রশ্ন করলাম, ‘কেন?’ ‘আপনি থাকলে সরকারি ত্রাণ বিলির কাজে অসুবিধে হচ্ছে।’ কথা বলছিলাম বীরভূমের মাখড়া গ্রামের নিহত কিশোর তৌসিফের দিদিদের সঙ্গে। ওঁদেরই একফালি উঠোনে বসে কথা বলে আমি কী ভাবে সরকারি ত্রাণ-বিলির কাজে বিঘ্ন ঘটালাম, বুঝতে পারলাম না। অফিসারও পরিষ্কার করে বোঝাতে পারলেন না। যেটা বোঝা গেল তা হল, গ্রামবাসীদের সঙ্গে আমার কথা বলাতেই ওঁদের আপত্তি।
এই আপত্তিটা আমার খুব চেনা। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, লালগড়, সর্বত্র, এমনকী নিয়মগিরি যাওয়ার পথে ওড়িশার মুনিগোড়া পুলিশ স্টেশনেও এই আপত্তি শুনেছি। এবং যখনই জানতে চেয়েছি ‘কেন আপত্তি’, জবাব শুনেছি— ‘বহিরাগত’। শব্দটা ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে এল। ক’দিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সময় সেখানকার প্রাক্তনীরা বা অন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও শুনেছে, তারা বহিরাগত।
মাখড়ায় এর আগে কখনও যাইনি। কিন্তু সেখানকার মানুষ ছুটে এসেছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে। এমনকী, পুলিশ যখন কথা বলতে না-দিয়ে ভ্যানে তুলল, তখনও তাঁরা চিৎকার করে, শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানালেন। তাঁদের, ওই গ্রামের বাসিন্দাদের, এক বারও মনে হয়নি, আমি বহিরাগত।
মনে পড়ে, আট বছর আগে সিঙ্গুরে যখন প্রথম পুলিশ ক্যাম্প বসল, সিঙ্গুরের মেয়েরা বলেছিলেন, ‘দিদি, পুকুরে স্নান করতে যেতে পারি না। বাইরের পুলিশগুলো ঘুরে বেড়ায়।’ মনে পড়ে লালগড়ের কথাও। সেখানকার মেয়েরা বলেছিলেন, ‘এই বাইরের পুলিশ আর মিলিটারি (অর্থাৎ, আধা-সামরিক বাহিনী) এসে আমাদের চলাফেরা বন্ধ হওয়ার জোগাড়।’
মাখড়া গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে শেখ আজহার আলির বাড়ি। রাজনৈতিক দলের এই এলাকা দখলের লড়াইয়ে প্রথমেই আক্রমণ হয়েছিল তাঁর বাড়িতে। ছেলের বিয়ে ছিল সে দিন। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে কিছু সোনা ছিল। সেই সব সোনাদানা, এমনকী রান্না-করা বা কাঁচা খাবারদাবার সব লুঠ হয়ে গিয়েছে। ঘরের দেওয়ালে, উঠোনের মেঝেতে গুলির দাগ। আতঙ্ক আছেই। তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মেয়েদের প্রতিবাদও চোখে পড়ার মতো। বাড়ির পাশের পুকুরটি দেখিয়ে তাঁরা বলেন, ‘এই পুকুরের ও দিকে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেছে।’ পুলিশি তথা প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় প্রকাশ্যেই ক্ষোভ উগরে দেন গ্রামের মেয়েরা।
অথচ, পঞ্চায়েত শাসক দলের। গ্রামটি এই সে দিনও ছিল শাসক দলের সমর্থক। অধিকাংশেরই ভারতীয় জনতা পার্টিকে সমর্থনের বয়স ত্রিশ দিনও পেরোয়নি। ওঁরা নিজেরাই এই তথ্য দিয়েছেন আমাকে। ‘কেন আপনাদের এই মত বদল?’ এ প্রশ্নের উত্তরে উঠে এল গত আড়াই-তিন বছরের অভিজ্ঞতা আর সেই অভিজ্ঞতাজনিত ক্ষোভ। প্রায় কেউই একশো দিনের কাজ করে প্রাপ্য টাকা পাননি। বিপিএল তালিকায় নাম আছে কিন্তু কিছুই পান না। পাশের গ্রাম মদনডাঙার রায়মণি মুর্মুও বলেন, ‘এখন ধান কাটতে যেতে পারছি না, কী খাব তার ঠিক নেই। এক বারও একশো দিনের কাজ করে টাকা পাইনি। বিপিএল কার্ডেও কিছু পাই না।’ সে কী? নালিশ করেন না কেন? গ্রামবাসীরাই জানালেন, সমস্ত কাজ হয় শাসক দলের পার্টি অফিস থেকে। এমনকী, বিডিও’র দফতরে বসে থাকেন পার্টির লোক। ফলে সেখানেও কিছু জানাতে যাওয়া যায় না। আর এই ১৪৪ ধারা জারির পর, গ্রামের সীমা পার হতে গেলেই, বলে যেতে হচ্ছে কোথায় এবং কেন যাওয়ার দরকার। আর সেই সঙ্গে আছে শাসক দলের পক্ষ থেকে নানা ছুতোয় টাকা আদায়। কখনও কখনও জরিমানা। অতিষ্ঠ গ্রামবাসী জানতে চান, ‘কী করব বলুন তো? কোথায় যাব?’ ঠিক এই প্রশ্ন শুনেছি লালগড়ে। সেখানে ছিলেন অনুজ পাণ্ডে। এখানে আছেন অনুব্রত মণ্ডল।
তা হলে বদলায়নি কিছুই? যা ছিল, তা-ই আছে? প্রশ্নের উত্তরে গ্রামবাসীরা জানালেন, সিপিএম আমলেও লুঠপাট দেখেছেন, কিন্তু এতটা দেখেননি। এতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি। তৌসিফের দিদি ময়না বিবি বলছিলেন, ‘একটা ছুঁচ কিনলে রাখতে পারব কি না সেটাই এখন সন্দেহ।’
মাখড়ার পুরো ইতিবৃত্তটাই এই সব কথা থেকে উঠে আসে। উঠে আসে এই সত্য যে, রাজনীতি মানে আজকের গ্রামবাংলায় কেবল এলাকা দখলের লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে শাসক দলের লাগামছাড়া স্বেচ্ছাচারিতার অত্যাচারে প্রশাসনের মদতের কাহিনি বলেন গ্রামের মানুষ। আর বলেন রাজনৈতিক প্রতিরোধের অভাবের কথা। সিপিএম কোথায় গেল, প্রশ্ন তুলতেই তাঁরা সমস্বরে বলেন, গোটা এলাকায় কর্পূরের মতো উবে গেছে সিপিএম, এত দুঃখের দিনে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি।
মিডিয়ায় উঠে এসেছে সুলেমানের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ‘কেন দেওয়া হবে’, সেই প্রশ্ন। বস্তুত সুলেমান ছিলেন অন্য গ্রামের মানুষ। অস্ত্র নিয়ে লড়তে এসেছিলেন শাসক পার্টির হয়ে। গ্রামবাসীরা বলেছেন সুলেমান বহিরাগত। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্নটা এই সব চাপানউতোরে তলিয়ে যাচ্ছে। সুলেমানের হাতে ছিল অস্ত্র। ‘বিসর্জন’ নাটকে প্রশ্ন ছিল, ‘এত রক্ত কেন?’ আজ সেই প্রশ্নের আগে আর একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে। ‘এত অস্ত্র কেন?’ পশ্চিমবঙ্গের একটি রাজনৈতিক দলও কিন্তু বলে না অস্ত্র উদ্ধারের কথা। প্রশাসন তো বলেই না। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকেই এই অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলার ছিল। কিন্তু প্রশাসন তো রাজ্যবাসীর জন্য নয়। কেবল একটি দলের বাড়বৃদ্ধির জন্য তারা সিংহাসন দখল করেছে। ‘রাজধর্ম’-এর অর্থই তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। রাজা যায়, রাজা আসে। গ্রামবাসীরা যে দিনানুদৈনিক আতঙ্ক আর চোখের জল মেখে ভাত খান, তার কোনও পরিবর্তন হয় না। গ্রামের নাম কখনও কখনও বদলে যায়। নন্দীগ্রামের বদলে লোবা বা মাখড়া, আবার কখনও কখনও বদলায় না। যেমন সিঙ্গুর।
এবং বদলায় না অসহায় মানুষগুলোর অন্তহীন যন্ত্রণার কাহিনি। নিহত কিশোর তৌসিফের বাড়ির পুরুষরা সব গ্রামছাড়া। বৃদ্ধ বাবা আর দিদিরা আছেন। এক বছর বয়সে তৌসিফ মাতৃহীন হয়েছে। দিদিরাই তার মা। আর তাই আজ তার মৃত্যুর পর শিশু তৌসিফের কথাই বার বার উঠে আসছিল তার দিদি ময়না বিবি আর আঞ্জিনা বিবির শোক-বিলাপে। নিজেরাই জানান, তাঁরা সবাই তৃণমূলের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু নানা দৈনন্দিন অত্যাচার আর প্রতিটি পদক্ষেপে তৃণমূলের লোকের নাক গলানোয় অতিষ্ঠ হয়ে যখনই কোনও প্রতিবাদ করেছেন, উলটে তৃণমূলের লোকেরা তাঁদের বাড়ির মেয়েদের উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করেছে। ভয় দেখিয়েছে ইজ্জত নিয়ে নেওয়ার। ময়না বলেন, ‘আপনি তো মেয়ে। আপনি বুঝবেন, এই সব কথায় কী রকম লাগে। এই ভাবে বেঁচে আছি দিদি।’
তৌসিফের বাড়ির উঠোন ভরে যায় গ্রামবাসীতে। সবাই বলতে থাকেন তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। এরই মধ্যে পুলিশ অফিসারের প্রবেশ। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কোনও অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা যায় না। তখন তাঁরা যুক্তি দেখান যে, আমি থাকলে সরকারি কাজে অসুবিধে হবে। সে যুক্তি যখন টিকল না, তখন ওপরওয়ালা আর এক জনকে ডেকে আনলেন। তিনি অবাঙালি। ভাঙা হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে বলেন, আমি থাকলে গ্রামবাসীরা জমায়েত হচ্ছেন, তাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হচ্ছে। অর্থাৎ, আমার সঙ্গে গ্রামবাসীদের কথা বলতে দেওয়া হবে না। কারণ, আমি বহিরাগত।
প্রশ্ন হল, কোনটা ‘ভিতর’ আর কোনটা ‘বাহির’? এই বিভাজনের কোনও সার্বিক, সর্বজনগ্রাহ্য সীমান্তরেখা আছে কি? কে কাকে ভিতরের, আর কাকে বাহিরের মনে করে, তারও কোনও ফর্মুলা আছে কি? যদি একটু বড় করে ভাবি, তা হলে ‘সীমান্ত’ ধারণাটাই একটা রাজনৈতিক বিভাজনের প্রকাশ। কৈশোরে দাদা-দিদিদের হাত ধরে সীমান্তহীন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে স্বপ্ন বাস্তব পৃথিবীর চাপে পড়ে একেবারে অ-বাস্তব হয়ে যায়নি আজও। দেখে দেখে জেনেছি যে, বিভাজনের সীমান্তটা মানুষকে কেবল টুকরোই করতে পারে। আর বুঝেছি, ওই সীমান্ত মেনে নেওয়া হল স্রোতের পক্ষে থাকা। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে ‘বহিরাগত’ তকমা লাগবেই। আজ পর্যন্ত কোথাও কোনও লড়াই, কোনও রাজনৈতিক যুদ্ধই বহিরাগতের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্পূর্ণ হয়নি। নৈতিক বা মানসিক সমর্থনটাও কিন্তু এক রকমের অংশগ্রহণ।
সীমানা তুলতে তুলতে আমাদের রাজনীতি এখন জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে সীমানা তুলে দিতে চায়। কারণ তা হলে দলের কর্তৃত্ব ফলানোর সুবিধে হয়। পুলিশ বা সেনা যখন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করতে বিরুদ্ধাচারী জনগণের মোকাবিলা করতে চায়, তখন কিন্তু এক ভাবে না এক ভাবে যুদ্ধই ঘোষণা করে। আর যুদ্ধ মানেই প্রতিপক্ষ। অন্য দলকে সমর্থন করতেও তখন মানুষ এগিয়ে যাবে। কাউকেই তখন বহিরাগত বলা যাবে না, কারণ সেখানে ভিতর-বাহিরের সীমানাটা রাষ্ট্রই ভেঙে দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy