মাদ্রাসা শিক্ষা এবং মুসলমানদের একাংশের চিন্তার অন্ধকার নিয়ে যখন চর্চা চলে, তখন আমরা আর একটা কথা বিশেষ খেয়াল করি না। সেটা এই যে, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এবং তার কুলীন চর্চাতেও দূরত্ব বজায় রাখার একটা চেষ্টা চালিয়ে আসা হয়েছে। স্কুলকলেজের পাঠ্য বইয়ে, অনেকটা সংরক্ষণের মতোই, মুসলমান লেখকদের রচনা দু’একটি রাখা হয়। কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সেই গঠনের যুগ থেকেই প্রক্রিয়াটা মূলত বিভেদ বজায় রাখার। মূল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পরিপূরক হিসেবে সুকুমার সেনকেও লিখতে হয় একটি আলাদা সাহিত্যের ইতিহাস, যা বাংলা সাহিত্য বটে, কিন্তু ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’। সে বইয়ের আলোচ্য সীমায় থাকে দৌলত কাজী বা আলাওলের রচনা, আরব্যরজনীর গল্প, সারি-জারি গান ও বিবিধ রোমান্টিক কাহিনি। কেন এ সব ইসলামি? ধন্দে থাকেন সুকুমার সেনও। বইয়ের ভূমিকাতেই লেখেন, ‘ইসলামি নামটি হয়ত সঙ্গত নয়, কেননা রচনা-রচয়িতা-ভাব-ভাষা কোন দিক দিয়েই এই সাহিত্যকে সর্বথা ইসলামি বলা যায় না। রোমান্টিক কাহিনি-কাব্যে পুরনো মুসলমান কবিদের বরাবরই একচ্ছত্রতা ছিল। কিন্তু কাব্যের বিষয় সর্বদা ফারসী সাহিত্যের অনুগত ছিল না।’ যেন সেটা হলেই ওই সাহিত্যকে ইসলামি বলে দাগিয়ে দেওয়া যেত!
সমস্যাটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতেই। উনিশ শতকে পাঠ্যপুস্তকের আদিপর্ব থেকেই। বাংলা স্কুলে প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকগুলি যে বিশেষ রূপে হিন্দু ছাত্রদের জন্য লেখা, সেই বিষয়ে অভিযোগ করে ১৮৯৯ সালে সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরী উর্দুতে প্রবন্ধ পড়েন। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘... এতদিন বিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্রসংখ্যাই অধিক ছিল এবং মুসলমান লেখকগণ বিশুদ্ধ বাংলা সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হন নাই। কিন্তু ক্রমশই মুসলমান ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়া চলিয়াছে এবং ভালো বাংলা লিখিতে পারেন এমন মুসলমান লেখকেরও অভাব নাই। অতএব মুসলমান ছাত্রদের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া পাঠ্যপুস্তক রচনার সময় আসিয়াছে।’
‘বিশুদ্ধ বাংলা’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বাংলা গদ্যের প্রতিষ্ঠা সেটাকেই বিশুদ্ধ লেখ্য বাংলা বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। আর সেটাই ছিল বাঙালি মুসলমানদের অভিমানের কারণ। জোর করে বাংলা ভাষায আরবি-ফারসি শব্দ চালানোর মতো সে অভিমানের অনেকটা অযৌক্তিকও। ১৯৪৪-এ কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটির যে প্রথম সম্মেলন হয় তার সভাপতির ভাষণে আবুল মনসুর আহমেদ স্পষ্ট মত প্রকাশ করেছিলেন: পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীর মুখের ভাষায়। সে ভাষা সংস্কৃত বা তথাকথিত বাংলা ব্যাকরণের কোনও তোয়াক্কাই করবে না। সেই ভাষণে এ-ও বলা হয়েছিল যে, বাংলার মুসলমানের নিজস্ব সাহিত্যের নাম মুসলমানি বাংলা সাহিত্য।
অর্থাৎ এই বিভাজনটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়েছিল, হয়ে থাকে। এমনকী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’-এও একটি আলাদা অধ্যায়ে ‘মধ্যযুগের মুসলমান কবি’রা আলোচিত। আশ্চর্যের কথা এই যে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মূলত ধর্ম-আশ্রিত হলেও মুসলমান কবি দৌলত কাজী ও আলাওল ধর্মের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন রোমান্টিক প্রেমকাহিনিকে। এবং আরও আশ্চর্যের কথা, অসিতকুমারের ইতিহাসে মুসলমান বৈষ্ণব কবিরাও বৈষ্ণব সাহিত্য অধ্যায়ে জায়গা পান না, তাঁদের ঠাঁই হয় ‘মধ্যযুগের মুসলমান কবি’ হিসেবে।
ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু আসলে ব্যতিক্রমী বলেই বাংলা সাহিত্যের ‘মূল’ স্রোতের ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন কয়েক জন মুসলমান লেখক। যেমন মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর ‘বিষাদসিন্ধু’ সাহিত্যের ইতিহাসে গদ্যের বিকাশপর্বেই আলোচিত। কিন্তু ‘বিষাদসিন্ধু’র প্রথম সংস্করণে তার জন্য মীর মশাররফ হোসেনকে স্পষ্ট লিখতে হচ্ছে, ‘শাস্ত্রানুসারে পাপভয়ে ও সমাজের দৃঢবন্ধনে বাধ্য হইয়া ‘বিষাদ-সিন্ধু’ মধ্যে কতকগুলি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করিতে হইল। বিজ্ঞমণ্ডলী ইহাতে যদি কোন প্রকার দোষ বিবেচনা করেন, সদয় ভাবে মার্জনা করিবেন।’
ব্যতিক্রম, অবশ্যই, নজরুল ইসলামও। তিনি প্রবল ভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই তথাকথিত মূল ধারায়। রবীন্দ্র- এবং রাবীন্দ্রিক কবিতার সযত্ন-লালিত মূল ধারায় তাঁর কবিতা বিদ্রোহের শামিল হয়ে থেকে গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যথার্থ নজরুল-চর্চা নগণ্য বললেই চলে।
সাধারণ ভাবে, সামগ্রিক প্রবণতার বিচারে প্রতিষ্ঠান-সম সাহিত্যের ইতিহাসে মেরুকরণের সেই ট্র্যাডিশন, সত্যিই, সমানে চলিতেছে। খাগড়াগড়ের সূত্রে আমাদের নিত্য সকাল-সন্ধ্যার যে গণমাধ্যমিক আলোচনা, তাতে এই ট্র্যাডিশন ভাঙার ইচ্ছেটাও দেখি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy