রাজকুমার হিরানি চমকে দিয়েছিলেন, আচমকা মহাত্মা গাঁধীকে হিন্দি সিনেমার হিরো করে। আর রাজা হরিশ্চন্দ্রকে ফ্যাশনে এনে তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন সাভজিভাই ঢোলাকিয়া। ইনি সুরাতের এক হিরে-ব্যবসায়ী, এ বছর নিজের কোম্পানির কর্মচারীদের দীপাবলির বোনাস দিয়েছেন এমন ফ্যান্টাসি উপচে, দেশ-বিদেশ হাঁ করে তাকিয়ে লক-জ! কর্মচারীদের মধ্যে ১২৬০ জনকে তিনি বললেন, বাড়ি, গাড়ি আর গয়নার মধ্যে যে কোনও একটা বেছে নাও। প্রত্যেকটার মূল্য তিন লাখ ষাট হাজার টাকা। তাই যে কর্মচারী মাসে মাইনে পায় চল্লিশ হাজার টাকা, সে ইচ্ছে করলেই নিয়ে গেল নতুন গাড়ি। যে কর্মচারী দুই-ঘরওয়ালা বাড়ি নিল, তাকে ফ্ল্যাটের বাকি টাকাটা শুধতে হবে অবশ্য, কিন্তু তা ধার পাওয়া যাবে কোম্পানি থেকেই, আর দেওয়া হবে কোনও সুদ ছাড়াই। লোকে বোনাস হিসেবে দেয় বড়জোর এক প্যাকেট করে মিষ্টি, সঙ্গে চাট্টি মিষ্টি কথা। তাইতেই সবাই গলে পড়ে। আর এই ভদ্রলোক কর্মচারীদের বোনাস দিতে গিয়ে কোম্পানির মোট ৪৫ কোটি টাকা খরচা করে বলেছেন, আমি কোনও বাড়তি অনুগ্রহ করছি না, আপনারা ভাল কাজ করেছেন, তাই এটা আপনাদের পাওনা। এটাকে একটা রি-ফান্ড হিসেবে ধরুন!
এখন অবশ্য সাভজির কোম্পানিটা বিরাট, ভারতের সেরা দশটা হিরে-কোম্পানির একটা, কিন্তু বিশ বছর আগে, যখন কোম্পানির টার্নওভার এক কোটি টাকা, তখনও দীপাবলিতে তিনি কোম্পানির সেরা তিন কর্মচারীকে একটা করে মারুতি গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। গত বছর, যে ৭২ জন কর্মচারী তাঁদের টার্গেট পূরণ করেছিলেন, পেয়েছিলেন একটা করে শেভ্রলে গাড়ি। তাই, এটা তাঁর ক্ষেত্রে আকস্মিক আচরণ নয়। তিনি মনে করেন, আমি এতটা টাকা লাভ করছি এদের জন্যে, এরাও তাই ভয়ানক খুশি থাকুক, কোম্পানি তাতে ভাল বই মন্দ চলবে না। এই লাভ মিলেজুলে ভাগ করে নেওয়ার ভাবনা বোকা-ফিল্মের চিত্রনাট্যে মিলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে কেউ নিয়মিত রূপায়িত করছে, অবিশ্বাস্য।
অথচ, ভাবলে, এই চিন্তাটাই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক ও উচিত। ‘দহন’ ছবিতে সুচিত্রা মিত্র অভিনীত চরিত্রটি বলেছিল, ট্যাক্সি ড্রাইভার লাখ টাকার ব্যাগ ফেরত দিলে, সবাই ‘সৎ সৎ’ চিল্লিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই ব্যাগটা তো তার নয়, ভুলে ফেলে যাওয়া প্যাসেঞ্জারের। তা হলে সেটা বাড়ি খুঁজে ফেরত দিয়ে যাওয়াটাই কি সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ নয়? তবে তাকে এক্সট্রা মহিমা চাপিয়ে মাথায় তুলছ কেন? উত্তরটা সোজা। মাথায় তুলছে, কারণ এ এমন সময়, যখন লোকটা ব্যাগ না ফেরত দিলে, তার বাড়ির লোক তো অবাক হতই না, এমনকী প্যাসেঞ্জারের বাড়ির লোকও হত না। সুযোগ পেলে যে লোকে চুরি করবেই, এটাকে এখন স্বতঃসিদ্ধ ধরা হয়। রাত্রে গলির মুখে ছিনতাই হলে কেউ ছিনতাইবাজের দোষ দেয় না, বলে: ‘বউমা, কী রকম তোমার আক্কেল যে বিয়েবাড়িতে ইমিটেশন না পরে আসল সোনা পরে গেলে, আবার রাত্তির করে হেঁটে ফিরছিলে ওই নির্জন রাস্তা দিয়ে?’ রাজনীতিকের ঘুষ খাওয়া, পুলিশের কোরাপ্ট হওয়া, সিনেমা-করিয়ে’র অন্য ভাষার সিনেমা থেকে ফ্রেম বাই ফ্রেম টুকলি মেরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো, এগুলো এমন ‘দুর্নীতিরে লও সহজে’ মর্মে গৃহীত, এ নিয়ে কেউ চেঁচামেচি করলে ‘ন্যাকাচন্দর’ আওয়াজ খায়।
এই জমানায় উন্নয়ন তার ঘর্ঘর-চাকাও ওই থিমেই গড়িয়েছে। তার অভ্যেস: কর্মীকে প্রাপ্য না দিয়ে অনেকটা করে চুরি, আর সেই টাকাটা প্রফিট হিসেবে নিজের ঘরে জমানো। কর্মীরাও তা সাপোর্টই করে। বাঃ, উনি মালিক, উনি সোনার কমোডে প্রাতঃকৃত্য করবেন না তো কি আমি করব? প্রাচীন সেই প্রশ্নগুলো, সেই দাড়িওয়ালা লোকের দেওয়াল-স্টেনসিল, সেই বিপ্লব দু’বছরের মধ্যে আসছে বলে এখন পড়া ছেড়ে দেওয়া (‘এই সিলেবাস তো বাতিল হচ্ছেই’), এ সব এখন কমেডি। লাভ তো করবেই, বেশ করবে লাভ করবে, এবং সেই লাভ-সরণির বাঁকে বাঁকে আমায় ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ লাথি মারবে: কেরানি সশ্রদ্ধ নোট করে। কখনও সেই লাথির দাগ নিজ পশ্চাদ্দেশের কাপড় তুলে সগৌরবে দেখায়ও। এই ভাবনা-চাঁদোয়ার নীচে, কোম্পানিরা ন্যাজ-মোচড়ান বাড়াচ্ছে কর্মীদের। রিসেশন এক বার থাবা হেনে চলে যাওয়ার পর, বার বার সেই জুজু দেখিয়ে মহানন্দে ছাঁটাই করছে এবং যেটুকু সুবিধে দিত তা-ও প্রত্যাহার করে বলছে, শুধু এর ওপর দিয়ে যাচ্ছে, এটাকেই ভাগ্য বলে ভাব রে গেধো। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমন প্রত্যাশাতীত বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত সাভজিকে আরও অনন্য করে। এমন নয়, শুধু দীপাবলি এলে তাঁর হাত খুলে যায়। সাড়ে ছ’হাজার কর্মীর সক্কলের মধ্যাহ্নভোজ ফ্রি। সবার সন্তানের পড়াশোনার পুরো খরচা দেয় কোম্পানি। প্রত্যেক কর্মীকে অন্তত দশ লক্ষ টাকার ইনশিয়োরেন্স করে দেওয়া হয়েছে, সবচেয়ে সিনিয়র ২৮০ জনের ক্ষেত্রে এই ইনশিয়োরেন্স এক কোটি টাকার।
অনেকে হয়তো এর পরেও বলবে, এগুলো খবর হওয়ার চেষ্টা। কিংবা, সত্যিকারের দান করতে হলে আরও টাকা দিতে হত, নিজের লভ্যাংশের তো মা-বাপ নেই, ছ’হাজার কোটি টাকার কোম্পানি। কিন্তু জিভ নাড়ানো খুব সোজা। আমরা কেউ কি আমাদের দুরন্ত প্রোমোশন হলে, তক্ষুনি বাড়ি ফিরে কাজের মেয়েটির মাইনে শনশনিয়ে বাড়িয়ে দিই? ড্রাইভারকে বলি, শোন রে, এদান্তি ভাল টাকা পাচ্ছি, তুইও পরের মাস থেকে এত করে বেশি পাবি? সেই আয়নার পাশে সাভজিকে দাঁড় করালে ঝাঁকি লাগবেই। অবশ্য তাবড় কোম্পানি-মালিকদের তা কক্ষনও হবে না, তাঁরা সাভজিকে ডেঞ্জারাস বা ছিটিয়াল হিসেবেই দেখবেন। এমনিতেই ওঁদের আয়না বিবেক-প্রুফ, এ বার সাভজি-প্রুফ করে নিতে আর কত পড়বে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy