আবার বাজেট আসছে। কিন্তু জনপ্রিয়তার রাজনীতি থেকে কি মোদী সরকার মুক্ত হবে?
’৪৬ সালের কথা। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান তখন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী।
জহওরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সেই সরকারে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ, দু’পক্ষই সামিল হয়েছিল। লিয়াকৎ আলির পেশ করা প্রথম বাজেট কিন্তু ছিল সাঙ্ঘাতিক জনদরদী। লিয়াকৎ আলি ছিলেন প্রভূত সম্পত্তির মালিক। দিল্লি ও মেরঠে ছিল তাঁর বিশাল সম্পত্তি। নিজে ধনী হয়েও তিনি পেশ করেছিলেন গরিবের বাজেট। এমনকী শিল্পপতিদের উপর তিনি প্রচুর কর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বাজেট ভাষণ শুধু নেহরু নন, মহম্মদ আলি জিন্না থেকে সর্দার পটেল সবাই শুনেছিলেন। প্রথমে নেহরুর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আসতে রাজি ছিলেন না জিন্না। কিন্তু পরে ঠিক হয়, দেশ যখন ভাগই হয়ে যাবে তখন যাওয়ার বেলায় ঝগড়াঝাটি না করে দু’পক্ষ বসে আলোচনা করে ভবিষ্যতের পথ চলা ঠিক করা ভাল। কিন্তু সে বারও বাজেটের প্রবল সমালোচনা হল। অধিকাংশ শিল্পপতির সঙ্গে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেই কারণে লিয়াকৎ এত শিল্পপতি-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেছিল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। আবার মুসলমান সমাজের জন্য ঢালাও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেই বাজেটে।
স্বাধীনতার পর প্রায় ৬৭ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। লিয়াকৎ আলি খান নিহত হয়েছেন। কিন্তু দেশের বাজেট পেশের ইতিহাসে বার বার ঘুরে ফিরে আসে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার অস্ত্র ব্যবহারের ট্র্যাডিশন। যখন যিনি শাসক তখন তিনিই কল্পতরু সাজতে চান। কোনটি দীর্ঘমেয়াদি ভাল তার চেয়েও বড় কথা হল কোনটি এখন ‘ফিল গুড’। গত ইউপিএ আমলে চিদম্বরমের বাজেট পেশের পরে সেই একই প্রশ্ন আবার ঘুরে ফিরে এসেছে। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মতে, “বাজেটে এই যে এত প্রসাদ দেওয়া হল সেটা মনে রেখে মানুষ কি আসলে ভোট দেয়? কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতাই ঝুঁকি নিতে চান না। ভোটের কথা ভেবে নরম বাজেট আসলে দেশের অর্থনীতির জন্য ভাল না খারাপ তার বিচার একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে কোনও দলই তো ভোটের আগে সাহস করে শক্ত বাজেট করেনি। তাই ভোটের সময় কাজ দেয় কি দেয় না তা বোঝার উপায় কী?”
কিছু দিন আগে দু’টি বেসরকারি সমীক্ষাকারী সংস্থা অবশ্য তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছে, সাধারণ ভাবে বাজেটে যে সব প্রস্তাব আনা হয় তা সবসময় নির্বাচনে প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু বাজেটের জনপ্রিয়তাকে অস্ত্র করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা দেখে অনেকের মনে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ যে জাগে না তা নয়। সমাজতান্ত্রিক অন্দ্রে ব্রেঁতের বক্তব্য, “বাজেট বিশারদ তো আমি নই। এটা আমার বিষয়ও নয়। ষাট হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ মকুব শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু এত টাকার জোগান কী ভাবে করা হবে তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে যায়।” ইউপিএ জমানায় এমনটাই বলা হয়েছিল। সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী মনে করেন, “আসলে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রাজনৈতিক ভাবে আমরা মুক্ত হলেও আমাদের মন এখনও মুক্ত হয়নি। এই ঔপনিবেশিক মনের জন্য কিছু দিন আগেও ব্রিটেনের সময় হিসাব করে এ দেশে বাজেট পেশ হত। বাজেট তো আসলে আয়-ব্যয়ের হিসাব। তাতে এত দর্শন খোঁজার চেষ্টার প্রয়োজন কী?”
বাজপেয়ী জমানায় বাজেট পেশের সময়টা অন্তত বদলেছিল। লন্ডনের সময়ের সঙ্গে হিসাব করে সন্ধ্যায় বাজেট পেশের জায়গায় সকাল বেলায় সেটা করা হবে কি হবে না সেটা নিয়েও বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠের মত আধুনিকতার পথেই হেঁটেছিল। বাজেট পেশের সময়টা না হয় বদলাতে রাজনৈতিক নেতারা আধুনিক হলেন। কিন্তু বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে জনপ্রিয়তার রাজনীতি বদলাতে কিন্তু এখনও কেউ রাজি নন। যখন যে বিরোধীপক্ষে তখন সে অভিযোগ তোলে বাজেট নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে রবিশঙ্কর-অরুণ জেটলি বিরোধী নেতা থাকার সময় বলেছেন, সংখ্যালঘু তোষণ হচ্ছে। ভোটের বাজেট হচ্ছে। তখন কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির যুক্তি, যদি মানুষের কথা ভেবে জনপ্রিয় কর্মসূচি নেওয়া হয় তবে সেটা তো ভাল। তার জন্য এত গোঁসা করা কেন? সমাজতাত্ত্বিক প্রতাপভানু মেটা বলেন, “সরকারের কাজই তো জনপ্রিয় কাজ করা। আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে ভুল সমালোচনা হচ্ছে। সরকারের হক আছে জনতার যা প্রিয় তা-ই করা। তবে হ্যাঁ, দেখতে হবে তা বোকার মতো করা হচ্ছে কি না। দীর্ঘমেয়াদি ফলের দিকে তাকিয়ে করা হচ্ছে কি না।”
আসলে রাজনৈতিক দল ও নেতারা সকলেই জনগণেশকে ভয় পান। নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী তখন মনমোহন সিংহই বিশ্বায়নের সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করেছিলেন। খোলাবাজারের অর্থনীতির হাওয়া যাতে প্রবেশের ছাড়পত্র পায় তার জন্য জানালা খুলে দিয়েছিলেন। অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে দু’টাকা কিলো চালের স্লোগান তুলে এন টি রাম রাও কংগ্রেসকে পরাস্ত করে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। কংগ্রেস এই স্মৃতি মুছতে পারে না। আর তাই বাম নেতৃত্ব যখন জনদরদী ভাবমূর্তির ‘সোল ডিস্ট্রিবিউটর’ হতে চান, জনসভা করে সরকারের কাছে জনপ্রিয়তার দাবি তুলে দেখানোর চেষ্টা করেন, আমজনতার রাজনীতিতে আমাদের কোনও শাখা নাই, তখন কংগ্রেসও এই প্রতিযোগিতামূলক জনপ্রিয়তার রাজনীতিতে অংশ নেয়। যে চিদম্বরম প্রথম বাজেট পেশ করার পর বিমা, টেলিকম, ব্যাঙ্কিং বেসরকারিকরণের ডাক দিয়েছিলেন, সংস্কারের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, এক সময়ে তিনিই সে সব ভুল ‘গরিবি হটাও’ লাইন নিয়েছেন।
বিগত লোকসভা নির্বাচনের মুখে অটলবিহারী বাজপেয়ী ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ গ্রহণের ঝুঁকি নিতে পারেননি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এনডিএ ক্ষমতায় আসবে। আর ক্ষমতায় এসে তখন একটা বিরাট দায় নিতে হবে। কিন্তু ওই জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফলে বিরাট খেসারত দিতে হয়েছিল বিজেপিকে। চিদম্বরম কিন্তু তাঁর বাজেটে সেই ঝুঁকি নেননি। আর বিজেপি আর্থিক সংস্কার ভুলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় লাইন নিয়ে বিরোধিতা চালিয়ে গিয়েছে। অথচ সরকারে থাকার সময়ে এই বিজেপি সংস্কার করতে গিয়ে ছ’বছর ধরে ঝগড়া করেছে আরএসএস ও স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের সঙ্গে।
কিন্তু এ বার কী হবে?
এ বার নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি অবশ্য নতুন কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য চাই আর্থিক শৃঙ্খলা। তাঁর প্রতি আস্থা বাড়াতে বলেছেন সাধারণ মানুষকে। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির প্রসারের জন্য চাই কড়া দাওয়াই। ’৯০-’৯১ সালে দেশের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ একদা এ কথা বলেছিলেন। আজ আবার বলছেন নরেন্দ্র মোদী। মানুষের সমর্থন নিয়ে ২৮০ আসনের একদলীয় শাসন প্রবর্তনের পর জনপ্রিয় রাস্তায় না হেঁটে কঠোর রাস্তায় হাঁটা বোধ হয় দেশের জন্য ভাল। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছেন, দু’টি স্কুল অফ থট আছে। প্রথমত, মানুষকে অসন্তুষ্ট না করে পপুলিজমের পথে হাঁটা। আর অন্য রাস্তাটি হল এখন কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে ভার লাঘব করা। অরুণ জেটলি এই দ্বিতীয় পথটি গ্রহণে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
রোগীকে সুস্থ করার জন্য প্রয়োজনে তাঁকে ইনজেকশন দিতে হয়। অপারেশনের জন্য ছুরিও চালাতে হয়। অতএব এ হল নতুন সরকারের নতুন চলার পথ। দেখা যাক এত বছরের জনপ্রিয়তার ভূত সত্যি সত্যিই ভারতের রাজনীতি থেকে মুক্ত হবে কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy