এখনও অনেক পথ। রূপান্তরকামীদের এক আলোচনাসভা। মুম্বই, ২০১৩। এএফপি।
গত ১৫ এপ্রিল ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (নালসা) বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়টি শুধু ঐতিহাসিক নয়, বৈপ্লবিকও। রায়ের ভাষায়: ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অধিকার মানবাধিকার। রাষ্ট্র আইনি সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে এঁদের অধিকার বলবত্ করবে। শিক্ষায় ও চাকরিতে সংরক্ষণও এঁদের প্রাপ্য হবে। বিচারপতি রাধাকৃষ্ণনের রায়ে ইন্টারসেক্স ব্যক্তিরা ও হিজড়ারা-সহ ট্রান্সজেন্ডারের আওতায় পড়বেন সেই সব নারী-পুরুষও, যাঁরা রূপান্তরকামী, অর্থাত্ শারীরিক ভাবে নারী হয়েও নিজেদের পুরুষ বলে মনে করেন, বা শারীরিক ভাবে পুরুষ হয়েও নিজেদের মনে করেন নারী। অর্থাত্, যাঁদের শারীরিক লিঙ্গ ও সেই লিঙ্গের কারণে যা যা সামাজিক অভিব্যক্তি হওয়ার কথা মানে, মেয়ে হলে মেয়েলি আর পুরুষ হলে পুরুষালি, তা ঠিক খাপ খায় না। ভেবে দেখুন, এই মানুষদের তো আবার সবই আছে, যা হিজড়াদের নেই, মানে রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব। কিন্তু, যে লিঙ্গপরিচয় তাঁরা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত, যা কিনা মানুষের প্রাথমিক, তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না-পেরে যে প্রতিদিনকার অস্বস্তি ও আত্মনিগ্রহ, বাপ-মা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশীর যে ঘেন্না মেয়ে হয়েও নিজেকে ছেলে ভাবে বলে বা শরীরে ছেলে হয়েও মেয়ে সে সব গ্লানিকে এই রায় বৈষম্য ও অসম্মান বলে চিহ্নিত করেছে। বলেছে যে, তাঁদের ওপরে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে চলে যে নির্যাতন, অত্যাচার আর অবমাননা, তার মোকাবিলা করার, তাঁদের সামাজিক বৈষম্য থেকে রক্ষার দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র।
প্রশ্নাতীত ভাবে লিঙ্গ-রাজনীতিতে এই রায়ের তাত্পর্য অসামান্য। কেননা, এই প্রথম বিধিবদ্ধ নারী-পুরুষের ভাগ, যার ওপর প্রজননকারী বিসমকামী পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজ দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে শারীরিক লিঙ্গ অর্থাত্ পুং-যোনির বিভাজন দিয়ে জানা যায় কে মেয়ে বা কে ছেলে, আর সেই মতো বোঝা যায় কে মেয়েলি আচরণ করে আর কে পুরুষালি, তার বাইরের অনেক লিঙ্গ-আচরণকে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক ভাবা হল।
বিশেষ করে হিজড়াদের কথায় আসি। আমরা তো ভেবেই নিয়েছি, হিজড়ারা সহজে ভিখ মেগে খায়, সমাজের মধ্যেই এই গুপ্ত লুপ্ত খোঁদলে থাকে, কিছুতেই মূলস্রোতে আসবে না। নানাবিধ রক্ত হিম করা গল্প কানে আসে, কানে আসে কী ভাবে একটা উভলিঙ্গ বাচ্চা জন্মালে তারা এসে জোরজার নিয়ে চলে যায়। খসখসে খ্যানখেনে গলার স্বরে উত্কট সাজে বাধ্যতামূলক টাকা দাবি করে। আমরা ভুলে যাই, আমাদের ইস্কুলে, পাড়ায়, পুজোয়, ঈদে, পরবে এদের জন্য কোনও জায়গা আমরা রাখিনি। কাজেই, হিজড়াদের জন্য সংরক্ষণ এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার এই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হল, যাকে সংবিধানে ১৬(৪) ধারা অনুযায়ী ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ বলে।
অন্য দিকে, যিনি নিজেকে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না, তাঁকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করার ও ইচ্ছা মোতাবেক লিঙ্গ-আচরণ করার স্বাধীনতা দেওয়ার ফলে স্বাধীনতার এক অন্য মানে তৈরি হল। আচরণের স্বাধীনতা খুব জরুরি। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে ছোটবেলায় কোনও বালক খেলুড়ে যদি ন্যাকা প্রকৃতির হত, তাকে আমরা কেমন সখি বলে ডেকে কেমন কুত্সিত ব্যঙ্গ করতাম, আর একটু বড় হলেই প্রকৃত পুরুষদের কাছে টিটকিরি ও নিয়মিত যৌন হেনস্থার শিকার হতে হত। বা নিজেকে পুরুষ সাজিয়ে রাখা মেয়েটির বুকের কাছে চোখ বুলিয়ে আমরা বুঝতে চেষ্টা করতাম লুকিয়েছে কতখানি। ওই সিনেমাটা তো অনেকেই দেখেছেন, যেখানে নিজেকে ছেলে ভেবে, ছেলে সেজে থাকার জন্য মেয়েটিকে শাস্তি দেওয়া হয় গণধর্ষণ। এই রায়টি এ কারণে ঐতিহাসিক যে, কেউ নিজেকে কোন সামাজিক লিঙ্গ হিসেবে ভাববেন, সেটা এই প্রথম নিজেকে প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হল সংবিধানের ১৯(১)(এ) অনুচ্ছেদ মোতাবেক। অর্থাত্, কেউ নিজেকে নারী ভাববেন না পুরুষ, আর সেই অনুযায়ী কী ভাবে নিজেকে প্রকাশ করবেন, কথা বলার ভঙ্গিতে বা পোশাকে-আসাকে, অন্যান্য আচার-আচরণে, তার অধিকার হিসেবেও। এঁরা এমনকী যদি সেই বিভেদ ঘোচাতে অস্ত্রোপচার করেন বা হরমোন প্রয়োগ করেন, ইচ্ছাকৃত মেয়েলি বা পুরুষালি আচরণবিধির মতোই সেটা তাঁদের নিজস্ব নারীত্ব বা পুরুষত্বের অভিব্যক্তির স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকার করতে হবে। রায়টি দাঁড়িয়ে আছে একটা বৈপ্লবিক উলটপুরাণের ওপর। মেয়ে/পুরুষ লিঙ্গচিহ্ন দিয়ে মেয়েলি/পুরুষালি হওয়ার বদলে মেয়েলি হলে মেয়ে আর পুরুষালি হলে পুরুষ, নিজের লিঙ্গ এই ভাবে উল্টো দিক থেকে বোঝার ওপরে। অর্থাত্, ব্যবহার মানে আত্মপরিচয় এখানে।
এই প্রশ্নগুলি উঠে আসবেই যে, তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নিজেকে শনাক্ত করা যেহেতু ব্যক্তির উপলব্ধির ওপর ছেড়ে দেওয়া হল অর্থাত্ তিনি যে রূপান্তরকামী এটা সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করে প্রমাণ করতে হবে তা নয়, বরং তিনি নিজেকে ও ভাবে ভাবছেন বলেই সেটা প্রমাণিত হবে তা হলে সেই মানসিক চাহিদা কতখানি হলে তিনি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে গণ্য হবেন, তা নির্ধারণ করার জন্য কারা থাকবেন মেডিক্যাল বোর্ডে, কী কী শারীরিক-মানসিক পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন তৃতীয় বলে? ধন্দ তৈরি হয় বিরাট। পিঙ্কি নারী না ইন্টারসেক্স, এই জানতে মেডিক্যাল পরীক্ষার নামে যা চলে, তাকে মানহানি ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি? আমরা প্রস্তুত তো?
আর একটা কথা। তৃতীয় লিঙ্গের প্রশ্নে, সমানাধিকার (সংবিধানের ১৪ ধারা), কোনও গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধতা (ধারা ১৫), নিজ প্রবণতা মতো আচরণ করার স্বাধীনতা (ধারা ১৯(১)(এ)) ও স্বাতন্ত্র্য (ধারা ২১) সংবিধানের এই যুক্তিগুলিকে আনা হয়েছে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে যে, ‘ব্যক্তির নিজ প্রবণতা অনুযায়ী লিঙ্গ আচরণ হল নিজের অভিব্যক্তির স্বাধীনতা’। কিন্তু নালসা রায়ে তৃতীয় লিঙ্গকে বৈধ লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় কখনওই লিঙ্গ আচরণকে যৌনতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। লিঙ্গ পরিচয়ের স্বাধীনতা, এই রায় অনুযায়ী, শুধু হাবভাব, পোশাক, এ সবের স্বাধীনতা। প্রশ্ন, যিনি শারীরিক ভাবে নারী, অথচ রূপান্তরকামী পুরুষ, তিনি নিজেকে পুরুষ/তৃতীয় লিঙ্গ বলে ভাবলেও তিনি নারীর প্রতি আকৃষ্ট হলে দু’টি শারীরিক নারী একত্রিত হয়; আর তিনি তো পুরুষকে কামনা করলেও গেরো, কেননা তিনি যেহেতু মনে মনে নিজেকে পুরুষ বলে জানেন, শরীরও বদলে ফেলতে পারেন, এবং তার ফল দাঁড়ায় দু’টি পুরুষের মধ্যে প্রেম (কাম), সে তো আবার ভারতীয় দণ্ডবিধির সেকশন ৩৭৭-এর আওতায় অপরাধ। গত ডিসেম্বরের ১১ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারাকে বলবত্ রেখে রায় দিয়েছে। লিঙ্গ আচরণের স্বাধীনতা মঞ্জুর হল, কিন্তু তার সঙ্গে যৌনতার প্রশ্নটি যোগ করা হল না। এর ফলে একটা বড় সমস্যা থেকেই গেল না কি?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy