কারিগর। নির্বাচনী জনসভায় অমিত শাহ। মির্জাপুর, উত্তরপ্রদেশ। ছবি: পিটিআই।
ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির অভাবনীয় সাফল্যের কারণ কী? এই প্রশ্ন নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে অনেক কথা শোনা গেছে। ‘মোদী ওয়েভ’ থেকে ‘সুনামো’— একটা অস্বাভাবিক তরঙ্গের কথা মেনে নিতে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু তার পরেও প্রশ্নটা থেকে যায়: এমনটা ঘটল কেন? আমাদের দেশের আগের আগের নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সাধারণত চার-পাঁচ শতাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন তা নিয়ে একটা দোলাচলে থাকেন, কোনও একটা দিকে বিশেষ হাওয়া থাকলে তাঁরা সে দিকে ঝুঁকে পড়েন। জাতপাত, ধর্ম বা জনগোষ্ঠী নির্বিশেষে এটা ঘটে থাকে। কিন্তু বিজেপি’র ভোটের অনুপাতে এ বার যে বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে (প্রায় ২৫ শতাংশ-বিন্দু), সেটা এই ধরনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আর একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রথমেই একটা কথা বলা দরকার। ইউপিএ জমানার দশ বছরে তরুণ ভোটারের সংখ্যা বিপুল ভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি, নতুন আর্থিক নীতির প্রসার ঘটেছে, বাজার আরও বিস্তৃত হয়েছে, উপভোক্তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। উত্তরপ্রদেশের গ্রাম ও শহরের চেহারা পালটে গেছে। ভাল ভাবে বাঁচার আকর্ষণ বেড়েছে, নানা ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছে, আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতাও। টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেটের প্রবেশ ঘটেছে সর্বত্র। সমাজের এই নতুন ভোগবাদী রূপ সমাজবাদী পার্টি বা বহুজন সমাজ পার্টি যথেষ্ট বুঝতে পারেনি, তারা সেই চিরাচরিত পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতিই আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে একটা প্রবল মধ্যবর্গ উঠে এসেছে, যারা ফেসবুক এবং টুইটারের মতো সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক শক্তি বানাতে তৎপর। এসপি বা বিএসপি এই নতুন গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি। বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদী সোশ্যাল মিডিয়া মারফত এঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন। ভোটে তার সুফল পেয়েছেন।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, যাঁরা আগের নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি এবং কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ এ বার বিজেপিকে সমর্থন করেছেন। শুধু উচ্চবর্ণের নয়, অনগ্রসর এবং দলিত ভোটারদের একটা বড় অংশও এ বার বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে এই দল এতটা সমর্থন আগে কখনও পায়নি। এর পিছনে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা কাজ করেছে। উত্তরপ্রদেশে দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা অমিত শাহ আরএসএস-এর প্রচারকদের সঙ্গে যৌথ ভাবে বিভিন্ন জাতভিত্তিক সংগঠনের কর্মকাণ্ডে শরিক হয়েছেন, অনগ্রসর ও দলিতদের এগিয়ে দিয়েছেন, মুজফফরনগর দাঙ্গার পরে হিন্দু ভোট এককাট্টা করার উদ্যোগে জোরদার ভূমিকা নিয়েছেন, দলিত এবং অনগ্রসরদের মধ্যে প্রচার করেছেন যে, কংগ্রেস মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য লালায়িত, হিন্দুদের নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। ওঁরা এটাও ব্যাপক ভাবে প্রচার করেছেন যে, এই প্রথম এক জন ওবিসি বর্গের মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। দলিতদের মধ্যে এ কথাও প্রচার করা হয়েছে যে, মায়াবতী তাঁদের জন্য সত্যিকারের কিছুই করেননি। পাশাপাশি, অমিত শাহ অম্বেডকর এবং অন্যান্য দলিত নেতাদেরও আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছেন, কাঁসিরামকে ভারতরত্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সংহতি কর্মসূচি শুরু করেছেন এবং সেবাভারতী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠনের সাহায্যে রাজ্যের বিভিন্ন দলিত অধ্যুষিত গ্রামে সভা করেছেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারে কল্যাণ সিংহ এবং উমা ভারতীর মতো অনগ্রসর শ্রেণির নেতাদের গুরুত্ব দিয়েছেন। এই নির্বাচনে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে অনগ্রসর শ্রেণির সাতাশ জন প্রার্থীকে টিকিট দিয়েছে। অনুপ্রিয়া পটেলের আপনা দল প্রধানত অনগ্রসর লোধ জাতির সংগঠন, এই দলের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে বিজেপি, তার সুফলও পেয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। এই বর্গের ভোট যথেষ্ট সংখ্যায় না পেলে বিজেপি এত আসনে জয়ী হতে পারত না। অমিত শাহ গোটা রাজ্যের জনবিন্যাসের একটা হিসেব কষেন এবং বিভিন্ন অনগ্রসর জাতির সংগঠনের সভায় যোগ দেন। এই সব জাতির প্রভাবশালী নেতাদের সামনে নিয়ে আসেন। তাঁদের মাধ্যমে জাতিগোষ্ঠীর সমর্থন নিশ্চিত করেন। রাজ্যের দুই অনগ্রসর শ্রেণির নেতা সত্যেন্দ্র কুশবহা এবং রামেশ্বর চৌরাসিয়াকেও তিনি সঙ্গে নেন। নরেন্দ্র মোদী যখন উত্তরপ্রদেশে বিজেপির শক্তি এবং প্রভাব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিজয়শঙ্খনাদ সমাবেশের আয়োজন করেন, তখন সভামঞ্চে কল্যাণ সিংহ ও উমা ভারতীকে গুরুত্বপূর্ণ আসন দেওয়া হয়। এই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় যে, শিক্ষা এবং কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাত অনুসারে আসন সংরক্ষণ করা হবে। এই প্রতিশ্রুতির তালিকায় যে সব জাতির স্থান ছিল তাদের মধ্যে আছে জাঠ, লোধ, কুর্মি, কুশবহা, মৌর্য, সাইনি, নিষাদ, কশ্যপ, পাল বাগেল, কুমার, সাহু ইত্যাদি। ভোটের টিকিট দেওয়ার সময়েও আঞ্চলিক জনবিন্যাসে এই সব গোষ্ঠীর গুরুত্বের হিসেব মাথায় রাখা হয়েছিল। যেমন উমা ভারতীকে ঝাঁসিতে প্রার্থী করা হয়, এটায় দাঁড় করানো হয় কল্যাণ সিংহের ছেলে রাজবীরকে, ফারুকাবাদে দাঁড়ান মুকেশ রাজপুত। এই ভাবে যে সব জায়গায় সমাজবাদী পার্টির দাপট ছিল, সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনগ্রসর শ্রেণিকে বিজেপির পাশে এনে দাঁড় করানো হয়েছে। এই কৌশল খুবই সফল হয়েছে। তেমনই, জনবিন্যাসের যুক্তিতে ফতেপুরে সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতিকে টিকিট দেওয়ার ফলে বিজেপি কশ্যপ এবং নিষাদদের সমর্থন পেয়েছে, আবার হামিরপুরে এক জন ঠাকুরকে দাঁড় করানো হয়েছে, বান্দায় টিকিট পেয়েছেন এক জন ব্রাহ্মণ। আর একটা কৌশল কাজ দিয়েছে। বিএসপি’র প্রধান জাতিগত ভিত্তি হলেন জাতভরা। জাতভ ছাড়া অন্যান্য দলিত গোষ্ঠী, যেমন পাসি, সানকর, রাওয়াত ইত্যাদির প্রার্থীদের বিভিন্ন জায়গায় টিকিট দিয়ে বিজেপির পক্ষে এবং মায়াবতীর বিপক্ষে দলিত ভোট সংহত করা হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে দলিতরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ। তাঁরাই মায়াবতীর বিএসপি’র জনসমর্থনের প্রধান ভিত্তি। শুধু দলিতদের ভোটে মায়াবতীর পক্ষে কোনও নির্বাচনে বেশি আসন পাওয়া সম্ভব নয়। অন্য নানা সামাজিক বর্গকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারলে তবেই দলিত ভোটকে যথেষ্ট আসনে রূপান্তরিত করা সম্ভব। বিএসপি’র প্রথম যুগে কাঁসিরাম প্রান্তিক, অনগ্রসর এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিএসপি’র ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে অনগ্রসর এবং দলিত বর্গের মধ্যে সামাজিক দ্বন্দ্ব প্রবল, তাই সেই উদ্যোগে স্থায়ী সাফল্য পাওয়া যায়নি। তবে অনগ্রসর শ্রেণির একেবারে পিছিয়ে থাকা কিছু অংশ এবং মুসলমান সমাজের একটা ছোট অংশ বিএসপি’র সঙ্গে থেকে গেছে। মায়াবতী যখন দেখলেন যে, অনগ্রসর শ্রেণিকে এককাট্টা করে রাখতে পারবেন না, তখন তিনি ব্রাহ্মণ, অন্য উচ্চবর্ণ এবং বণিকদের সঙ্গে নিয়ে সামাজিক পুনর্গঠনের (সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) পথে যেতে চাইলেন। ২০০৭-এর বিধানসভা এবং ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তিনি সফলও হলেন। এ বারেও তিনি ওই কৌশল কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে কুড়ি জন ব্রাহ্মণ এবং উনিশ জন মুসলমানকে টিকিট দিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। ব্রাহ্মণরা তো একযোগে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেনই, দলিত এবং সবচেয়ে প্রান্তিক বর্গের প্রায় ষাটটি জনগোষ্ঠীর মানুষও বিজেপির পক্ষে এসেছেন, কারণ বিএসপি’র জমানায় তাঁরা কিছুই পাননি।
দলিত এবং সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কথা অনুধাবন করে আরএসএস অনেক দিন ধরেই তাদের মধ্যে কাজ করে আসছে। সামাজিক সংহতি প্রচার অভিযানের মাধ্যমে তারা ওই গোষ্ঠীগুলিকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, তাদের বিজেপির সমর্থক করে তোলার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই প্রয়াসের ফল দেখা গেছে এ বারের ভোটে। দলিত এবং বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণির ভোট নিজের দিকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেও সংহত করেছে, কিন্তু অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সূক্ষ্ম ভাবে। রামমন্দিরের মতো বিষয়গুলি নিয়ে মোদী সরাসরি কোনও প্রচার করেননি, কিন্তু তিনি সুকৌশলে নিজের হিন্দুত্বকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। মুসলিমদের ‘স্কাল ক্যাপ’ পরার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, হিন্দুত্ব এবং হিন্দু আচারের ব্যাপারে তিনি কোনও আপস করতে রাজি নন। ‘উন্নয়নের প্রতীক’ নরেন্দ্র মোদীর সাফল্যের এই তাৎপর্যটি উত্তরপ্রদেশের প্রেক্ষিতে মাথায় রাখা দরকার।
ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে জি বি পন্থ সোশাল সায়েন্স ইনস্টিটিউট-এ ইতিহাসের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy