Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
সাক্ষাৎকার

আমাদের বামপন্থীরা আত্মঘাতী, কিন্তু এ দেশে বামপন্থা ছাড়া গতি নেই

পার্টির এ-রকম দুর্দশা হল, তার একটা বড় কারণ, পার্টির সঙ্গে, বিশেষ করে এই রাজ্যের পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বাইরের পৃথিবীতে কী হচ্ছে, দেশের ও রাজ্যের লোকেরা কী বলছে, কী চাইছে এবং নেতাদের সম্বন্ধে কী ভাবছে, সেটা তাঁদের জানা দরকার। তা জানতে হলে খোলাখুলি সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দ্বিতীয়ত, নেতারা কী ভাবছেন, কী করতে চাইছেন সেটাও বাইরের লোককে জানানো দরকার। অশোক মিত্রের সাক্ষাৎকার নিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়।পার্টির এ-রকম দুর্দশা হল, তার একটা বড় কারণ, পার্টির সঙ্গে, বিশেষ করে এই রাজ্যের পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বাইরের পৃথিবীতে কী হচ্ছে, দেশের ও রাজ্যের লোকেরা কী বলছে, কী চাইছে এবং নেতাদের সম্বন্ধে কী ভাবছে, সেটা তাঁদের জানা দরকার। তা জানতে হলে খোলাখুলি সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দ্বিতীয়ত, নেতারা কী ভাবছেন, কী করতে চাইছেন সেটাও বাইরের লোককে জানানো দরকার। বললেন অশোক মিত্র। সাক্ষাৎকার নিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০০:৩৯
Share: Save:

আপনি সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের এই ব্যর্থতা একটা গভীর সংকটের পরিণাম, তার মোকাবিলা করতে না পারলে সিপিআইএমের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত। এই সংকট কি অনেক দিন ধরেই জমে উঠছিল না?

একটু পুরনো কথায় ফিরে যাই। আমি ১৯৮৪ সালে হঠাৎ কেন বাম মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম? আমি তখনই ওঁদের জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, পার্টির বিরুদ্ধে আমি বাইরে একটা কথাও উচ্চারণ করব না, কিন্তু আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়। কারণ আমি দেখছিলাম, যে আদর্শের কথা ভেবে আমি নিজের বৃত্তি ছেড়ে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম, তা ছেড়ে পার্টি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ নেতারা কেউ কেউ প্রয়াত, কেউ কেউ অবসন্ন, ক্লান্ত, পার্টির ভিতরে কী হচ্ছে তা যেন তাঁরা ঠিক দেখছেন না, বা দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। শেষ পর্যন্ত যখন আমাকে বলা হল, বেসরকারি কলেজের যাঁরা অধ্যক্ষ, তাঁদের সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের সমান বেতন দিতে হবে, তখন আমি ঠিক করলাম, ঢের হয়েছে, আর নয়।

কেন, আমি সেটা বলি। আমি এমন অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী মানুষের কথা জানতাম, যাঁরা সুযোগ পেয়েও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের পদ নেননি, পড়ানো ভালবাসতেন বলে শিক্ষকতাতেই থেকে গিয়েছিলেন, যদিও অধ্যক্ষ পদে বেতন ও অন্যান্য সুবিধে অনেক বেশি ছিল। তখন নানা বেসরকারি কলেজে এমন অনেক অধ্যক্ষ ছিলেন, যাঁদের যোগ্যতা যথেষ্ট ছিল না, দলীয় নেতারা তাঁদের সেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে বলা হচ্ছিল, তাঁদের সুশোভন সরকার, তারকনাথ সেন, সুবোধ সেনগুপ্তদের চেয়ে বেশি মাইনে দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, ‘এটা ঠিক হবে না, আপনারা মুড়িমিছরির দর এক করতে যাবেন না, তাতে দক্ষতা চুলোয় যাবে, আখেরে শিক্ষার সর্বনাশ হবে, সমাজের সর্বনাশ হবে। আপনারা তো গোটা দেশকে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে একটা সুষ্ঠু সৎ প্রশাসনের উদাহরণ দেখাতে চান। কিন্তু অন্যায় দূর করতে গিয়ে যদি আপনারা অন্যায়কেই প্রশ্রয় দেন, তা হলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?’ কিন্তু ওঁরা সেটা শুনতে চাইলেন না।

আসলে পার্টি এক সময় বশ্যতা আর দক্ষতার তফাত করতে ভুলে গেল। আরও অনেক সমস্যা ছিল, কিন্তু আমার মনে হয় এটাই আসল। পদত্যাগের কিছু দিন পর দিল্লি গেলে দলের এক প্রবীণ নেতা, একদা দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন, ঝেড়ে বকুনি দিলেন, ‘তুমি একটা গাধা, পার্টির ভেতরে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া তোমার কর্তব্য ছিল।’ স্বীকার করি, অন্তর্দলীয় কোঁদল চালাবার মতো প্রতিভা বা মানসিকতা কিছুই আমার নেই।

আপনি অনেক দিন আগে কমিউনিস্ট পার্টির দুটি ধারার কথা লিখেছিলেন। প্রাকৃত এবং সংস্কৃত। মুড়িমিছরি এক করে ফেলার মধ্যে কি প্রাকৃত ধারার একটা প্রভাব ছিল?

বামফ্রন্টের প্রধান দলে যাঁরা যোগ দেন, তাঁদের মধ্যেও কিছু বিশিষ্ট, সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন। স্বয়ং জ্যোতি বসু অত্যন্ত দায়িত্বশীল, সৌজন্যপূর্ণ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সামগ্রিক নেতৃত্বের যে চাপ, উঁচুদরের প্রবীণ নেতারা সেই চাপটা আটকালেন না।

এখানে কি সরকার আর পার্টির মধ্যে বিরোধ ঘটল? পার্টি নিজের মতটা চাপিয়ে দিল?

ব্যাপারটা অনেকটা এ-রকমই। দলের সিদ্ধান্ত হয়েছে, ফ্রন্টের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুতরাং প্রশাসনকে তা মানতে হবে। প্রশাসনের যে কতকগুলো আলাদা বক্তব্য থাকতে পারে, সেটা ধৈর্যের সঙ্গে শোনার সময় সেই মুহূর্তে কারও ছিল না। তত দিনে, বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তোলার পরে, তাঁরা তো ধরে নিয়েছিলেন, ‘চিরকাল পশ্চিমবঙ্গে শাসন করে যাব।’ সোজা কথা, এই সাফল্যে তাঁদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এবং সেটাই মারাত্মক হয়ে দাঁড়াল। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই দেখা যাচ্ছিল পার্টির মধ্যে নেতারা কেউ কেউ একটু অহঙ্কারে ভুগছেন, চাটুকারদের দ্বারা পরিবৃত হচ্ছেন, চাটুকাররা বাছা বাছা ক্ষমতার জায়গায় পৌঁছচ্ছেন, তাঁরা আবার তাঁদের চাটুকার তৈরি করছেন। এই ভাবে বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত তৈরি হল, পুরো দলটায় ঘুণ ধরল।

কিন্তু তার পরেও তো দীর্ঘ দিন বিরাট জনসমর্থন ছিল। ২০০৬-এও। সাফল্য। তার দু’তিন বছরের মধ্যে ধস নামল কেন?

এটার কারণ হচ্ছে, উনিশশো নব্বইয়ের দশকে এবং এই শতাব্দীর প্রথম দশকের গোড়ার দিকে বামফ্রন্টের প্রশাসন এবং তার নানান শাখাপ্রশাখা যে ধরনের মানসিকতা নিয়ে কাজকর্ম করছিলেন, তাতে কিছু লোকের মনে গভীর অসন্তোষ এবং বিরক্তি জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কোনও বিকল্প দেখছিলেন না। মন্দের ভাল হিসেবে তাঁরা বামফ্রন্টকে সমর্থন করছিলেন। জ্যোতি বসু তখনও বেঁচে। তাঁর সম্বন্ধে বাঙালির, বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজের মনে এক আশ্চর্য স্বপ্নালু মায়াবোধ ছিল। এখনও আছে। আমি এই সমস্ত কথাগুলো বলছি এই কারণে যে, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে এই আন্দোলনের সঙ্গে, এই পার্টির সঙ্গে একাত্ম থেকেছি। বর্তমান বিপর্যয়ের গ্লানি আমাকেও সমান স্পর্শ করেছে, তার দায়ও। ১৯৮৪ সালে মন্ত্রিসভা ছেড়ে দেওয়ার পরেও আমি দলের বাইরে নিজেকে ভাবিনি। আমি এটাও সবিনয় দাবি করব যে, পার্টির ভেতরে যাঁরা আছেন, যাকে আমি বলব পার্টির সমর্থনের বৃত্ত, তাঁদের অনেকে আমাকে পার্টির এক জন বলেই মনে করেন, যদিও নেতৃত্ব তা মনে করেন না। এমনকী ১৯৯৩ সালে পার্টি থেকে যখন আমাকে রাজ্যসভায় যেতে আহ্বান জানানো হল, আমি খানিকটা উৎসাহের সঙ্গেই সম্মত হলাম, প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস বিষয়ে মন্ত্রিসভায় থাকাকালীন— জ্যোতিবাবুর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে— দেশে এক বিশেষ ধরনের আলোড়ন তুলতে অংশত সফল হয়েছিলাম, সংসদে গিয়ে ফের তা নিয়ে উত্তাল হব, কারণ ইতিমধ্যে বামফ্রন্ট সরকার এ বিষয়ে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বড় কারণ, দু’বছর আগে, তথাকথিত মুক্ত অর্থনীতি প্রবর্তনের পর দেশ জুড়ে আর্থিক সংকট যে ক্রমশ ঘনীভূত এবং এই পথে দেশের যে মুক্তি নেই, তা গোটা দেশের প্রতিনিধিদের সামনে উচ্চারণের সুযোগ পাব। দলীয় বিচ্যুতির কথাগুলি আমি বরাবরই আত্মসমালোচনা হিসেবে বলেছি।

পার্টি নতুন পৃথিবী, নতুন বাস্তবের মোকাবিলা করতে পারল না বলেই কি এ বিচ্যুতি ঘটল?

প্রথম কথা, যে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে পার্টিতে নতুন আগমনপ্রার্থীদের যাচাই করা হত, আমার মনে হয়, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সেটা ঢিলে হয়ে গেল। প্রবীণ নেতারা একটু অন্যমনস্ক, একটু শ্রান্ত, তার সুযোগ গ্রহণ করলেন কিছু কিছু নবীন, ভূতপূর্ব ছাত্রনেতা কিংবা যুবনেতা, তাঁরা এই প্রবীণ নেতাদের প্রধান উপদেষ্টা ও সহায়ক হলেন, এবং তাঁদের যারা সমর্থক ও পেটোয়া মানুষ, তারা কাতারে কাতারে পার্টিতে ঢুকে পড়ল।

অন্য আর একটা দিক আছে। যদিও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কথা বলা হয়, এবং এখনও পর্যন্ত নিয়ম হল, কেন্দ্রই শেষ কথা বলবে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তা-ই হয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রের পার্টির মধ্যে যে সম্পর্ক, তা একটু অন্য রকম। কেন্দ্রে যাঁরা হাল ধরে আছেন, তাঁদের নিজেদের অঞ্চলে প্রভাব অত্যন্ত সীমিত। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে, তাঁদের পেছনে এত জমাট একটা আন্দোলন, এত সম্ভ্রান্ত একটি প্রশাসন। তাই অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পছন্দ হোক বা না হোক, এ রাজ্যের নেতৃত্বের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর পার্টির সিদ্ধান্ত অনেকটাই নির্ভর করত। যদিও কোনও কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানতেন, পশ্চিমবঙ্গে এখানে ওখানে অনেক গলদ ঢুকছে, তাঁদের কিছু করার ছিল না। তাঁরা অসহায় বোধ করতেন।

পশ্চিমবঙ্গে পার্টির দীর্ঘ নির্বাচনী সাফল্যই কি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কিছু না করার একটা কারণ ছিল? তাঁরা কি মনে করতেন, রাজ্য নেতৃত্ব যখন ভোট আনছেন, তখন তাঁরা যে ভাবে পার্টি চালাচ্ছেন সে-ভাবেই চালান?

তাঁরা ভাবতেন, আমরা দূর থেকে কী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেব? ওরা এতগুলো নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, ওরা জানে স্থানীয় অবস্থা কী রকম, কী করা উচিত। সিঙ্গুর নিয়ে হট্টগোলের পরে অবস্থাটা প্রকট হয়ে গেল।

কিন্তু একটা কমিউনিস্ট পার্টির তো কেবল ভোটের হিসেব কষার কথা নয়। তার আদর্শ সে কতটা অনুসরণ করতে পারছে, বাস্তব অনুযায়ী সেই আদর্শের পরিমার্জন দরকার কি না, এগুলোও তার ভাবার কথা। তেমন চিন্তার লক্ষণ তো দেখা গেল না!

একটা উদাহরণ দিই। ভূমিসংস্কারের কথা ধরা যাক। বর্গাদারদের আইন করে অধিকার পাইয়ে দেওয়া হল। কিছু কিছু ভূমিহীন মানুষ এক ছটাক দু’ছটাক করে জমি পেতে শুরু করলেন। ব্যাঙ্কের ওপর চাপ দিয়ে কিছু কিছু টাকার ব্যবস্থাও হল। কিন্তু এর পরে কী হবে? ওই যে ছোট ছোট জমি, তার উৎপাদনশীলতা তো অত্যন্ত সীমিত। এবং আজ যাকে একটু জমি দিলাম, কাল গিয়ে তো তাকে বলতে পারি না যে, এসো, তোমার জমির সঙ্গে পাশের জমি মিলিয়ে দিয়ে একসঙ্গে চাষ-আবাদ করো, তা হলে উন্নতি হবে। সমবায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করা উচিত ছিল। বীজ, সার, ফসল ইত্যাদি ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমবায় আন্দোলনকে কাজে লাগাতে পারলে কৃষিজীবীর লাভ হত, এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সমবায়ের প্রয়োজন অনেক ভাল বুঝতে পারতেন। কিন্তু সে দিকে নজর দেওয়া হল না। তার পরে ফ্রন্টের সব ভাগাভাগি ব্যাপার ছিল, সমবায় ছিল এক শরিক দলের হাতে। নানা সমস্যা।

একটা উদাহরণ দিই। ভার্গিস কুরিয়েন আমার অনেক দিনের বন্ধু, একসঙ্গে কাজ করেছি, তাঁকে বললাম, ‘তুমি পশ্চিমবঙ্গের জন্যে একটা মাদার ডেয়ারি তৈরি করে দাও।’ তিনি বললেন, ‘তুমি বলছ, আমি নিশ্চয়ই করে দেব।’ দিলেনও। কিন্তু দু’বছর যেতে না যেতেই দেখা গেল অদ্ভুত ব্যাপার। যে ধারণাটা কুরিয়েনের বরাবর ছিল, তা হল, ছোট বড় সবাই মিলে সমান অধিকার প্রয়োগ করবে, ক্ষুদ্রতম কৃষক বা দুধওয়ালাও দাবি করতে পারবেন যে, ‘এই যে দুধ, মাখন, পনির, এমনকী মিষ্টি দই তৈরির মস্ত ব্যবস্থাটা দেখছ, এটা আমারও।’ কিন্তু এখানে মাদার ডেয়ারিতে প্রথম থেকেই কে কত মাইনে পাবে, সে সব নিয়ে দল থেকে নাক গলানো শুরু হল। এই নিয়ে আর একটা গল্প শুনেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গে তিনি আরও মাদার ডেয়ারি খুলছেন না কেন, এই প্রশ্নের জবাবে কুরিয়েন নাকি বলেছিলেন, ‘দেয়ার আর টু মেনি বেঙ্গলিজ ইন বেঙ্গল’!

ছোট ছোট জমিতে চাষের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও তো ঠিক মতো হয়নি, কৃষিঋণ...

মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক, এই সব রাজ্যে নাবার্ড থেকে বছরে চার হাজার, পাঁচ হাজার, ছ’হাজার, আট হাজার, দশ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সেখানে বড়জোর পাঁচ-সাতশো কোটি। এটাই তফাত।

নীচের থেকে কোনও চাপ এল না? কৃষক সভা এ সব নিয়ে পার্টিকে চাপ দিল না?

তত দিনে কৃষক সভায় পঞ্চায়েতের প্রাধান্য বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পঞ্চায়েতের হাতে টাকা আছে, কৃষক সভার হাতে টাকা নেই। এবং আর একটা ব্যাপার— কোনও কোনও জেলায় বর্গা বিলির ফলে পার্টির সমর্থকদের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাসেরও একটা পরিবর্তন দেখা দিল। যাঁরা ছোট বর্গাদার ছিলেন তাঁরা মধ্য বর্গাদার হলেন, যাঁরা মধ্য বর্গাদার ছিলেন তাঁরা বড় বর্গাদার হয়ে গেলেন। তাঁদের গোষ্ঠীস্বার্থ পার্টির ঘোষিত আদর্শ থেকে একটু সরে গেল। একটা গল্প মনে পড়ছে। ১৯৬২ সালে পঞ্জাবের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ছ’জন কমিউনিস্ট বিধায়ক পার্টি ছেড়ে দিলেন। এবং কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে তাঁরা কংগ্রেসে যোগ দিলেন না, যোগ দিলেন স্বতন্ত্র পার্টিতে। কমিউনিস্ট পার্টি এত দিন সেচের ওপর কর বসানোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, জমি পাইয়ে দেওয়ার আন্দোলনগুলোও সফল হয়েছে, এঁরাও আর ছোট কৃষক নেই, মাঝারি কৃষক হয়ে গেছেন, বিত্তবান হয়ে গেছেন...

এ বার শ্রেণিস্বার্থ...

শ্রেণিস্বার্থটা পালটে গেছে। এটা পঞ্জাবে তো চোখের সামনে দেখেছি। সম্ভবত সেই কারণেই, যদিও পার্টি ভারতের অন্য প্রায় সর্বত্র খেতমজুর ফেডারেশন তৈরি করেছিল, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য নেতৃত্ব থেকে তা করার অনুমতি মেলেনি।

পশ্চিমবঙ্গের শিল্প উন্নয়ন সম্পর্কেও তো দীর্ঘ দিন বামফ্রন্ট প্রয়োজনীয় সচেতনতার পরিচয় দেয়নি।

শিল্পায়নের জন্য পুঁজিপতিদের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একটি আদর্শসম্মত বিকল্প সুযোগ বামপন্থী নেতা-মন্ত্রীরা হাতছাড়া করেছিলেন। ২০০৪ সালে কেন্দ্রে সরকার গঠনে কংগ্রেস দলকে সমর্থনের সুবাদে বামফ্রন্ট তিনটি সুস্পষ্ট শর্ত আরোপ করতে পারত: (১) পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা পূর্ব ভারতে ব্যাঙ্ক ঋণ অন্তত দশগুণ বাড়াতে হবে; (২) পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্ব ভারতে কৃষি শিল্প পরিষেবা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পাঁচ বছরে দশ গুণ বাড়াতে হবে; (৩) বামদের পূর্বসম্মতি ছাড়া অর্থ কমিশন ও যোজনা কমিশনের সদস্য নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। পাশাপাশি, জমি অধিগ্রহণের সমস্যা নিরসনের জন্য যে কৃষকদের জমি নেওয়া হল, আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট শিল্পের আংশিক মালিকানা তাঁদের প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট করা যেত। কিন্তু বামফ্রন্টের নেতারা সে-সব নিয়ে আদৌ ভাবলেন না, ভাসা-ভাসা সদিচ্ছা-ঠাসা একটি যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে নিশ্চিন্ত মনে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন জানালেন।

ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও তো সাধারণ শ্রমিকের স্বার্থ না দেখে ইউনিয়নের নেতারা...

আমার মনে পড়ছে, উত্তর চব্বিশ পরগনার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা অনেক দিন ধরে বন্ধ হয়ে ছিল। তা, সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ হল, ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে ঋণের ব্যবস্থা করা হল, যাতে খুব ভাল ভাবে পরিচালনা করা যায় সে জন্য শ্রমিকদের মধ্যে থেকে দু’এক জন প্রতিনিধি নেওয়া হল। এক জন শ্রমিক নেতাকে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হল। তাঁকে বার বার বলা হল, ‘আপনাকে দেখতে হবে যেন কোনও টাকাপয়সার অপচয় না হয়, যাতে উৎপাদন বাড়ে,’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সপ্তাহ বাদে আমার চোখে ভিরমি লাগল— দেখি, সেই শ্রমিক নেতা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির একটা গাড়ি নিয়ে সারা কলকাতা আর চব্বিশ পরগনা চক্কর দিচ্ছেন। এই রকম ছোট ছোট অনেক ঘটনা আছে। এবং মানুষ বোকা নয়, তাঁরা সবই দেখেছেন, প্রথম দিকে নিঃশব্দে মেনে নিয়েছেন, তার পর এক সময় তিতিবিরক্ত হয়ে ভেবেছেন যে, ‘ঢের হয়েছে, আর পারছি না।’ সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, শালবনির পরে যেটা হল, লোকে মনে করল, যে-ই আসে আসুক, এদের আর নয়। তা-ও তো খুব বেশি নয়, ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন থেকে ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে পার্টির ভোটের অনুপাত ছয় শতাংশ কমেছিল, ২০১১’র বিধানসভা নির্বাচনে আরও দুই শতাংশ। কিন্তু এ বারের লোকসভা ভোটে বারো শতাংশ কমে গেল। তিন বছরে একেবারে ধস নেমেছে।

সেটা তো অনেকখানি এই জন্যেই যে, পার্টি ক্ষমতায় ছিল বলে তার সংগঠন ছিল, ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরে সেটাও সঙ্গে সঙ্গে...

সংগঠন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। আর কিছু কিছু ফালতু লোক যারা এসেছিল তারা সরে গেছে।

আপনি কী ভবিষ্যৎ দেখেন?

আমি একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলছি এবং খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলছি। এই নেতৃত্বের কারও সঙ্গেই আমার বৈরিতা নেই, কেউ কেউ আমার বাড়িতে আসেন। তা হলেও আমি বলছি যে, এখন মানুষ কতকগুলো মুখ আর দেখতে চায় না। সেই মুখগুলো যতক্ষণ থাকবে, তারা পার্টির দিকে ফিরবে না। আর মুখগুলো সরাতে যত দেরি করা হবে, তত জনসমর্থন কমে যাবে। এখন বলা হচ্ছে, শুনতে পাই, ‘আমরা নভেম্বরে পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেব।’ নভেম্বর আসতে এখনও পাঁচ মাস বাকি, ইতিমধ্যে আরও কত সর্বনাশ হবে কে জানে। অথচ আমার মনে পড়ে, ১৯৫০ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি যখন একটা গভীর সংকটে পড়ে, তখন গোপন সভা ডেকে খুব দ্রুত নেতৃত্ব পরিবর্তন করা হয়েছিল।

কিন্তু এটাও কি ঠিক নয় যে, এখন পার্টির যে অবস্থা হয়ে আছে তাতে নেতৃত্বে খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করতে চাইলে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে?

না, তা হবে না। নতুন নেতৃত্ব এসে পুরনো পার্টিকে আবার নতুন করে গড়তে হবে। এখানে আমার বন্ধুদের অনেকে বলছেন, এই পার্টি দিয়ে আর কিছু হবে না, একটা একেবারে নতুন সংগঠন করতে হবে। আমি তা মনে করি না। এখনও কিছু কিছু মানুষ, অভ্যাসবশত হোক, ঐতিহ্যবশত হোক, ধরে নেন যে বাম মানেই মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। সুতরাং এই জনসমর্থনকে সম্মান জানিয়ে এই পার্টিটাকে সংশোধন করার চেষ্টা করা যাক। এটা হচ্ছে আমার নিজের মত। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমার সঙ্গে একমত নন।

কিন্তু এটা তো কেবল নেতৃত্ব বদলের ব্যাপার নয়, এখানে তো নীতি এবং কার্যক্রম পরিবর্তনের একটা প্রশ্ন আছে। নতুন ভাবে দেখার দরকার আছে।

পার্টির এ-রকম দুর্দশা হল, তার একটা বড় কারণ, পার্টির সঙ্গে, বিশেষ করে এই রাজ্যের পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কারণ আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, ভারতীয় সংবিধান যা-ই বলুক, পশ্চিমবঙ্গের শাসন থেকে আমাদের কেউ বিচ্যুত করতে পারবে না, বিপ্লব হোক বা না হোক, এখানে আমরা একতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেছি, সুতরাং বাইরের কারও কথা শোনবার আমাদের দরকার নেই। এখন, আমি ওঁদের একটা কথা বলতে চাই। সেটা হল, ‘লেনিন যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটা করেছিলেন একটি বিশেষ অবস্থায়। পার্টি গোপন ছিল, পার্টির একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিপ্লব সাধন। একটা গোপন দলকে বিপ্লব সফল করতে হলে অটুট শৃঙ্খলা দরকার এবং সেই কারণেই গোপনীয়তার একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এখন আপনারাই বলছেন, বিপ্লব দূর অস্ত্, পার্টির সভায় মিছিলে আপনারাই বেশ কয়েক বছর হল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ উচ্চারণ বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আপনারা এই গণতান্ত্রিক বহুদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে নির্বাচনে লড়ে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতায় পৌঁছতে চান। তা হলে দুটো জিনিস করতে হবে। এক, বাইরের পৃথিবীতে কী হচ্ছে সেটা আপনাদের জানা দরকার। দেশের লোকেরা কী বলছে, কী চাইছে এবং আপনাদের সম্বন্ধে কী ভাবছে, এগুলো আপনাদের জানতে হবে, এবং জানতে হলে আপনাদের খোলাখুলি সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আপনারা কী ভাবছেন, কী করতে চাইছেন সেটা বাইরের লোককে জানানো দরকার। আপনারা হয়তো বলবেন, ‘আমরা সজাগ আছি, পার্টির ভিতরে সব কিছু আলোচনা করে নিচ্ছি।’ কিন্তু এটাই একটা বড় সমস্যা। লেনিন যুগে সোভিয়েত পার্টিতে সর্বস্তরের মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে শোনা হত। আর হালের পশ্চিমবঙ্গে সেই পবিত্র নীতি নিছক বাঙালি জমিদারিতে পরিণত হয়েছে। নেতারা সভা ডাকেন, লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেন, তার পর এক জন দু’জন সাধারণ সদস্য কাকুতিমিনতি করে কিছু বলার চেষ্টা করলেই তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়, চিঠি লেখার অনুজ্ঞা জানিয়ে সভা শেষ। তা ছাড়া, বাইরের মানুষ দেখছে আপনারা অনেক নীতি-নিয়ম মানছেন না, তাই আপনারা পার্টির ভিতরে কী আলোচনা করছেন সে কথা তাঁরা জানতে চান। এবং সেটা যতক্ষণ আপনারা তাঁদের জানতে না দেবেন, আপনাদের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস কমবে না।’

অনেকের মত হল, সিপিআইএমের এই সংকট আসলে বুঝিয়ে দেয় যে, কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজন ফুরিয়েছে...

যদি দেশ থেকে বাম আন্দোলন উধাও হয়ে যায়, তা হলে গরিব ও মধ্যবিত্তদের ওপর শোষণ অত্যাচার অনাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে বাধ্য। যাঁরা বলেন, গোটা দেশের আর্থিক উন্নতি হলেই সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র মিলিয়ে যাবে, তাঁরা বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। যদি বাধাবন্ধহীন মুনাফা করার একচ্ছত্র ক্ষমতা সমাজের ওপরের শ্রেণির মানুষের হাতে চলে যায়, তাঁদের বিবেক তাঁদের সংযত হতে বলবে না, যদি বলত তা হলে কোনও শিল্পপতি পাঁচ থেকে দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মুম্বই শহরে নিজের বসবাসের জন্য বাহারি অট্টালিকা তৈরি করতেন না, যে মুম্বইয়ের ষাট শতাংশ মানুষ ঝুপড়িতে বাস করেন। সুতরাং যত দিন দারিদ্র থাকবে, অসাম্য থাকবে, বামপন্থী আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা আদৌ কমবে না, বরঞ্চ আরও বাড়বে।

অন্য বিষয়গুলি:

asoke mitra aniban chattopadhyay left front
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy