ই এন ফরস্টারের ‘এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ বইতে চন্দ্রপুর নামে এক গ্রামের গল্প ছিল। মাড়ওয়ার গিরিগুহার বিশ মাইল দূরে অবস্থিত ওই গ্রামটি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। কিন্তু সেই চন্দ্রপুরের ছিল বেহাল অবস্থা। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ওই বইটি থেকে জানা যায় চন্দ্রপুরের দারিদ্র কী ভাবে তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। এবং এই গ্রামটি ছাড়িয়ে শহরে গেলেই ছবি ছিল অন্য রকমের। সিভিল লাইনস, লাল ইঁটের তৈরি ‘সিভিলিয়ান’-দের ক্লাব বাড়ি। চন্দ্রপুরের নিচুতলার সঙ্গে এই এলাকার কোনও মিল নেই। এই দারিদ্রের মধ্যেও সেই গ্রামের একটি চরিত্র আজিজ কিন্তু তাঁর মুসলিম সত্তা নিয়ে ছিলেন বিশেষ সচেতন। ফরস্টারের এই বইয়ের ‘মসজিদ’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়ে সে জনজীবনের ছবি পাওয়া যায়।
গাঁধীনগরে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জয়পুর অধিবেশনে
পত্তাভি সীতারামাইয়ার সঙ্গে বল্লভভাই পটেল।
স্বাধীনতার আগে থেকেই সংখ্যালঘু নামক বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে বিতর্ক হয়েছে। কী ভাবে স্বাধীনতার পর ভারতীয় মুসলমান সংখ্যালঘু সমাজকে দেখা হবে, কী ভাবে তাদের সমস্যার সমাধান করা হবে তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য ছিল। গাঁধী ও নেহরু শুধু নয়, অম্বেডকরের সঙ্গে নেহরুর, সর্দার বল্লভভাই পটেল এবং গোবিন্দবল্লভ পন্থের সঙ্গে মতপার্থক্যের কথা বিস্তর জানা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, আজ ২০১৪ সালে ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা এখনও সংখ্যালঘু সমস্যা এবং হিন্দু-মুসলমান বিতর্ক নিয়ে পীড়িত। এই সমস্যার সমাধান কী ভাবে হবে তা জানি না। উল্টে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে যেখানে ৮০টি লোকসভা আসন রয়েছে সেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ বাড়ছে বই কমছে না। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে মুজফফরনগর এলাকায় জাঠ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ আজ সুবিদিত।
স্বাধীনতার পর যে জাতীয়তাবাদের কথা ভেবেছিলেন নেহরু, সেখানে এই সংখ্যালঘু সত্তাকে তিনি আলাদা করে গুরুত্ব না দিয়ে এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমসত্ত্ব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিলেন। এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই শব্দগুলি রাখার ব্যাপারে নেহরুকে প্রস্তাব
দিয়েছিলেন এস রাধাকৃষ্ণণও। যিনি পরবর্তীকালে দেশের রাষ্ট্রপতি হন। নেহরু রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদকে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা অনেকটাই পশ্চিমি ধ্যান-ধারণার ধাঁচে। দেশভাগের পর এই আলাদা ধর্মীয় সত্তাকে একটি আলাদা জাতি সত্তা হিসাবে দেখতে নেহরুও রাজি ছিলেন না। গণপরিষদের বিভিন্ন বিতর্কে সংখ্যালঘু কমিটির প্রধান ছিলেন বল্লভভাই পটেল। সেই সময়ে গোবিন্দবল্লভ পন্থ মুসলিম প্রতিনিধিদের বলেছিলেন, তোমরা যদি ভারতের সুসংহত অঙ্গ হয়ে উঠতে পার সেখানেই তোমাদের নিরাপত্তা রয়েছে। এই গণপরিষদের খসড়া কমিটির আর এক জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন কে এন মুন্সি। তিনি সাবেক হিন্দু নেতা ছিলেন। তিনি পন্থকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভারতকে আর বহুধা রাষ্ট্র না ভেবে সমসত্ত রাষ্ট্র হিসাবে ভাবা উচিত। মুসলমান প্রতিনিধিরা পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী চেয়েছিলেন। তখন বল্লভভাই তীব্র বিরোধিতা করে বলেছিলেন, তোমরা কি দেশে শান্তি চাও না? এই কথাগুলি বল্লভভাই বলেছিলেন ১৯৪৭-এর ২৭ অগস্ট।
জওহরলাল নেহরু
বি আর অম্বেডকর
গোবিন্দবল্লভ পন্থ
এই কথা তিনি যখন বলছেন তখন দিল্লি-সহ বিভিন্ন প্রান্তে দাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। সেই দাঙ্গার শিকার হয়েছিল মুসলিম জনসমাজ। পরের দিন, ২৮ অগস্ট মুসলিম নেতারা ওই একই দাবিতে সোচ্চার হন। তখন পটেল রেগে গিয়ে বলেন, যাঁরা এ সব দাবি করছেন তাঁরা পাকিস্তানে চলে যেতে পারেন। আমরা এখন অখণ্ড ‘নেশন’ চাই। এক বার দেশ ভাগ হয়েছে। আর ভাগ বাঁটোয়ারা চাই না। আপনারা আর ভাঙনের বীজ বপণ করবেন না।
আজ এত বছর পর মনে হচ্ছে স্বাধীনতার পর নেহরু-পটেল-পন্থের মধ্যে বিতর্ক যা-ই হোক না কেন, এখন ক্রমশ একটি জিনিস মনে হচ্ছে, একটি নেশনের জাতীয়তাবাদকে স্টিম রোলার দিয়ে চাপিয়ে দেওয়াটা বোধ হয় উচিত রাজনীতি ছিল না। রাধাকৃষ্ণণ-নেহরু যেটা চেয়েছিলেন সেটা একটা আদর্শ পরিস্থিতি। চোখের সামনে পাশ্চাত্যে মডেলের রোমান্টিসিজম ছিল। কিন্তু ভারতের মতো এত বড় একটি দেশে শুধু মুসলমান নয়, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট্রানের মতো বহু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। নানা জাতি-উপজাতি রয়েছে। এত জটিল বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যদি বিভিন্ন জাতিসত্তার মুক্তি না ঘটানো হয় তাতে যে কী বিপদ হতে পারে তা আমরা ৬৮ বছরে বুঝে গিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন সংবিধানে পৃথক হয়ে যাওয়ার অধিকার দিয়েছিল বিভিন্ন রাজ্যকে। কিন্তু স্তালিন বাস্তবে একটি লৌহ জাতি রাষ্ট্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ভাষার ভিত্তিতে আমরা রাজ্য ভাগ করেছি, কিন্তু হিন্দি জাতীয়তাবাদকে চাপিয়ে দিয়েছি গোটা দেশের উপরে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলেছি, কিন্তু মুসলমান জনসংখ্যাকে ভোট ব্যাঙ্কের বাক্স ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে শিখিনি।
দাঙ্গা যারা করে তারা গুন্ডা। তারা নাগরিক নয়। কিন্তু রাজনেতারা ভোটের স্বার্থে চিরকালই সেই গুন্ডাদেরও আড়াল করেছে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গা নিয়ে গবেষণা করেছেন আয়েশা জালাল। তিনি শুধু নন, জাপানের এক তরুণ গবেষক নারিয়াকি নাকাজাতো বলেছেন ওই সময়ে কলকাতায় দাঙ্গা ঘটিয়েছিল সমাজবিরোধীরা। তৎকালীন গভর্নর ব্যারোজও তাঁর রিপোর্টে বলেছিলেন, ওই দাঙ্গার পিছনে রয়েছে সমাজবিরোধী শিবির। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতার লালবাজার ক্রিমিনাল বিভাগে তৎকালীন ফাইলগুলিতে হিন্দু গুন্ডাদের তথ্য থাকলেও, মুসলমান সমাজবিরোধীদের নাম নেই। রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ সেই তখন থেকে সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। যা এখনও চলছে।
১৯৪৬-এর দাঙ্গায় ধর্মতলা চত্বরে জ্বলছে ডেলিভারি ভ্যান।
গবেষক-অধ্যাপক ক্রিস্টোফর জাফরেলট বলছেন, ‘কম্পোজিট কালচার’ আর ‘মাল্টিকালচারালিজম’ কিন্তু এক নয়। নানা ধরনের সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। ভারত যত বেশি বহুধা সংস্কৃতির দেশ ততটা সুসংহত সংস্কৃতির দেশ নয়। ক্রিস্টোফার আরও বলেছেন, সংখ্যালঘু শব্দটির বদলে বহুধা জাতিসত্তাকে শব্দটির ব্যবহার করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে মার্কিন মুলুকে। সংখ্যালঘু তকমা দিয়ে ভোটের স্বার্থে তাকে ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ ব্যবহার করা আর যা-ই হোক সাংস্কৃতিক সমন্বয় নয়। নেহরুকে চিঠি দিয়ে সর্দার পটেল প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দেশভাগের পর ভারতে যে মুসলমানেরা রয়ে গিয়েছে তাদের সম হারে বিভিন্ন রাজ্যগুলিকে বণ্টন করে দেওয়া হোক। নেহরু রাজি হননি। তিনি মনে করেছিলেন, যান্ত্রিক ভাবে এ ভাবে একটি জনসমাজকে এক স্থান থেকে অন্যত্র পাঠানো অবৈজ্ঞানিক ও তাতে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আরও বেশি হবে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ধর্মীয় মেরুকরণ আবার একটা কালাপাহাড়ের মতো চ্যালেঞ্জ হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
—ফাইল চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy