ভারতে জন্ম, কিন্তু বিশ্বের অন্যতম প্রধান হয়ে ওঠা একটি অ্যাপ-নির্ভর খাবার ডেলিভারি সংস্থা সম্প্রতি যে মহৎ কাণ্ডটি করে দেখিয়েছে, তা মানবসম্পদ ম্যানেজমেন্টের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন হিসেবে দেখা যেতে পারে। সাত-দশ-বারো দিন নয়, সদ্য সন্তানের মুখ দেখেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য একেবারে ১৮২ দিনের সবেতন ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ। মায়েরা তো ছুটি পেয়েই থাকেন। নতুন কী! এ বারে নব্য বাবারাও মায়েদের মতো একই ব্র্যাকেটে চলে এলেন। সন্তানের যত্ন-আত্তি করার জন্য ছাব্বিশ সপ্তাহের ছুটি, অর্থাৎ ১৮২ দিন। এমনটা হয়নি এর আগে। চব্বিশটি দেশে ব্যবসা ছড়ালেও সংস্থাটি মূলত ভারতীয়। ফলে ওই সংস্থায় কর্মরত নব্য বাবাদের মুখের হাসিটাও এ বার আরও চওড়া হল।
হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থা বাদ দিলে বেসরকারি ক্ষেত্রে ছুটি জিনিসটা বরাবরই চোখ কুঁচকে দেখা হয়। ‘হাউ ডু ইউ জাস্টিফাই টুডে’স স্যালারি?’-র মতো প্রশ্নে দিবারাত্র জর্জরিত হচ্ছেন না, দেশের বেসরকারি মহলে এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। এ শহরের অন্যতম নামী সংস্থায় কাজ করা আমার এক পরিচিত মধ্য পঞ্চাশের ভদ্রলোককে সম্প্রতি তাঁর বাবাকে দাহ করে বাড়িতে আসার পরেও ল্যাপটপ খুলে কাজে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল। সিনিয়র ম্যানেজার পদের ওই ভদ্রলোক প্রায় করজোড়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে শ্মশান থেকে টেলিফোনে মিনতি করেছিলেন, ‘আজকের দিনটা ছেড়ে দিন। অত্যন্ত ইমার্জেন্সিতে আছি।’ এর উত্তরে তাঁকে শুনতে হয়েছিল, ‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু এই অ্যাসাইনমেন্টটাও ইকুয়ালি আরজেন্ট।’ এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যখন গড়পড়তা সংস্থাগুলিতে ছুটি মঞ্জুর হওয়ার এমন কালো হাল, তখন, এই বেরঙিন সময়ে ওই বহুজাতিকটির ছাব্বিশ সপ্তাহের সবেতন ছুটি মঞ্জুর করার বিষয়টি খানিকটা তাজা হাওয়া এনে দিল।
বেসরকারি সংস্থাগুলিতে পিতৃত্বকালীন ছুটি যে নেই, তা নয়। তবে নব্য বাবাদের ছুটি দিতে বাধ্য নয় কোনও বেসরকারি সংস্থা। এ নিয়ে এই দেশে কোনও আইনও নেই। সরকারি কর্মচারীরা অবশ্য আইন অনুযায়ী পনেরো দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটি পেয়ে থাকেন। শিশুর জন্মের আগের পনেরো দিন থেকে জন্মের পরের ছ’মাসের মধ্যে এই ছুটি নেওয়া যায়। কোনও কোনও বেসরকারি সংস্থায় এইচ আর-এর নোটবুক অনুযায়ী পাঁচ থেকে বারো দিনের একটা ছুটি দেওয়া থাকে। তবে ওই পর্যন্তই। এই ছুটি পাওয়া যায় না। রক্তিম চোখের ভ্রুকুটিতে যে প্রশ্নগুলো সদ্য বাবা হওয়া লোকদের শুনতে হয়, তা হল, ‘কিসের ছুটি? আরে আপনার রোলটা এখন কি?’, ‘বাড়িতে বসে কি আপনি বাচ্চাকে ফিড করাবেন?’, ‘সি-সেকশন তো হল মিসেসের, আপনারও কি ব্যথা হচ্ছে?’ ইত্যাদি। প্রশ্নগুলো অনেক সময়ই চটুল হয়, শালীনতার সীমা ছাড়ায়। চাকরি রক্ষার ভয়ে অধিকাংশ সময়েই এর প্রতিবাদ করা যায় না। একটি প্রখ্যাত বিস্কুট কোম্পানিতে কাজ করা আমার এক স্কুলজীবনের বন্ধুর মুখে সম্প্রতি শুনলাম, পিতৃত্বকালীন ছুটি চাইতে যাওয়ায় ওর বস্ মুচকি হেসে বলেছেন, ‘আমার বৌয়ের যে দিন ডেলিভারি হয়, সে দিনও আমি অফিস করেছি। হ্যাভ মিঠাই, শেয়ার অ্যান্ড গো ব্যাক টু ওয়ার্ক।’ অথচ ওই সংস্থারই ভিশন এবং মিশনে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘এনশিয়োরিং এমপ্লয়ি গ্র্যাটিফিকেশন’ নামক তিনটি শব্দ।
কাজের জগতে নারীরা যেন কোনও রকম বৈষম্যের শিকার না হন, এই নিয়ে মানবসম্পদের কারবারিরা বড় বড় ফোরাম করেন দেশের পাঁচতারা হোটেলে। মাতৃত্বকালীন ছুটি আরও বাড়ানো যায় কি না, এই নিয়ে পর্যালোচনা হয়, পিরিয়ডস লিভ চালু করা নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে খুব, কিন্তু এমন কোনও ফোরামে পিতৃত্বকালীন ছুটিটা বেসরকারি ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ভাবে বলবৎ করা যায় কি না, এ নিয়ে একটা কথাও কাউকে বলতে শোনা যায় না। এমন সময়ে দু’কদম এগিয়ে ওই খাবার ডেলিভারি সংস্থার কর্তা ঘোষণা করলেন, ‘পৃথিবী জুড়ে আমাদের যত অফিস আছে এবং তাতে যত মহিলা কর্মী আছেন, সবার জন্য ছাব্বিশ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি আমরা দিচ্ছি। অবিকল একই সুবিধা পাচ্ছেন পুরুষরাও। আমাদের প্রতিষ্ঠানে এখন থেকে পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির মধ্যে আর কোনও রকম ফারাক থাকবে না।’
মা হওয়া যে মুখের কথা নয়, সে কথা তো সবাই জানেন। এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগ। পুরুষ, নারী প্রত্যেকে নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যেই তো বহু মানুষ একে একে দুই দুইয়ে একে তিন হচ্ছেন। সমীক্ষা বলে, যদি কেরিয়ার দিয়েই ‘মূল্য’ দেওয়ার কথা আসে, তা হলে পরিবারে নতুন সদস্য এলে সেই মূল্য অনেকটাই বেশি দিতে হয় মায়েদের। বাবাদের ইচ্ছে হলেও পাশে থাকার কোনও উপায় থাকে না। ব্যক্তি এবং কর্মজীবনে বৈষম্যের এ-ও তো এক রূপ। দু’জনেই যদি নবজাতকের পাশে কিছু দিন হলেও একসঙ্গে থাকতে পারেন, তা হলে ‘মূল্য’ দেওয়ার প্রসঙ্গটিও ফিকে হয়ে আসে। নিজেদের সংস্থায় ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্সের উৎকর্ষতা নিয়ে নানা গ্রাফ এবং ম্যানেজমেন্ট গুরুদের কোটেশন সহযোগে যাঁরা বক্তব্য রাখেন, তাঁরা এই বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন। পরিবারের পাশে থাকার এর চেয়ে ভাল এবং মহৎ সুযোগ মানুষের জীবনে তো বার বার আসে না।
শিশুরা মায়ের মনমাঝারের ইচ্ছেকুসুম। এ সত্য চিরন্তন। প্রতিটি শিশুর পিতাও তো সেই ছোট্ট, কোমল মানুষটির অন্তরে ঘুমিয়ে থাকেন। এইচ আর-এর নোটবুক যেন তা ভুলে না যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy