শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থশাস্ত্রী রিচার্ড এইচ থেলার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে চিনিবেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। আদিত্যনাথ থেলারকে চিনিবেন, সম্ভাবনা ক্ষীণতর। কিন্তু নিয়তির কী বিচিত্র পরিহাস, দ্য রয়্যাল সুইস অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস যখন থেলারকে এই বৎসরের অর্থশাস্ত্রের নোবেলপ্রাপক হিসাবে বাছিয়া লইল, তাহার মাত্র এক দিন পূর্বেই আদিত্যনাথ এমন একটি সিদ্ধান্ত করিলেন, যাহা তাঁহাদের দুই জনকে বাঁধিয়া দিল এক আপাত-অবিচ্ছেদ্য গ্রন্থিতে। আদিত্যনাথ ঘোষণা করিয়াছেন, তাঁহার রাজ্যে যে অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে পাঠাইবেন না, পুলিশ তাঁহাদের গ্রেফতার করিয়া পাঁচ দিন বিনা অন্ন-জলে বন্দি করিয়া রাখিবে। সমালোচকরা বলিবেন, থেলারের ‘নাজ’-দর্শন শেষ অবধি এই পরিণতিতেই পৌঁছায়। সন্তানকে স্কুলে না পাঠাইবার সিদ্ধান্তটির সহিত এমন কঠোর নেতিবাচক প্রণোদনা জুড়িয়া দিলে মানুষ আপনা হইতেই যথার্থ পথে হাঁটিতে থাকিবে। অথবা, রাষ্ট্র যাহাকে যথার্থ বলিয়া মানে, সেই পথে। সমালোচকরা শুনাইয়া দিবেন, রিচার্ড থেলারের লিবার্টারিয়ান পেটার্নালিজম বা উদারপন্থী নিয়ন্ত্রণবাদ কি এই কথাই বলে না? অর্থনীতির সত্য রক্ষার্থে বলা বিধেয়, আদিত্যনাথ বা মোদী-ট্রাম্প আদি নেতাদের ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণের সহিত থেলারের ‘নাজ’-এর ধারণাটির দূরত্ব ঠিক ততখানিই, শিকাগো স্কুলের দর্শন হইতে নাগপুরের পাঠশালার দূরত্ব যতখানি। থেলারের ধারণার মূলে রহিয়াছে একটি বিশ্বাস— মানুষের চয়নের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চলিবে না; কিন্তু সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে চয়নের বিকল্পগুলিকে এমন ভাবে সাজাইতে হইবে, যাহাতে মানুষ তাহার নিজের পক্ষে সর্বাধিক উপকারী বিকল্পটিই বাছে। কিন্তু, স্বাধীন ভাবে বাছে। রাষ্ট্রের গুঁতা খাইয়া নহে।
থেলারের প্রধানতম কৃতিত্ব, সিদ্ধান্ত করিবার সময় মানুষ কোথায় এবং কেন যুক্তির পথ হইতে বিচ্যুত হয়, তাহাকে তিনি কয়েকটি সহজ সূত্রে বাঁধিয়া দিয়াছেন। মানুষের আলস্য, সাময়িক প্রলোভনের ফাঁদে পা দেওয়ার প্রবণতা, ভবিষ্যৎকে ছোট করিয়া দেখা ইত্যাদি ব্যাধিকে পাশ কাটাইয়া কী ভাবে মানুষকে তাহার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পক্ষে অনুকূল সিদ্ধান্তের পথে ঠেলিয়া দেওয়া যায়, থেলার তাহা দেখাইয়াছেন। সর্বাধিপত্যকামী রাষ্ট্রের ন্যায় তিনি বলেন নাই যে প্রত্যেক কর্মীকে তাঁহার আয়ের একটি অংশ জমাইতেই হইবে। পরিবর্তে, তিনি একটি ফন্দি দিয়াছেন— যত ক্ষণ না কেহ এই সঞ্চয় না করিবার সিদ্ধান্তটি স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেন, তাঁহার আয়ের একটি অংশ আপনা হইতেই জমিতে থাকিবে। তিনি শিশুদের স্কুলে ফাস্ট ফুড রাখিতে বাধা দেন নাই। শুধু বলিয়াছেন, স্বাস্থ্যকর খাবারগুলিকে এমন জায়গায় রাখিতে হইবে যাহাতে সেগুলি সহজেই চোখে পড়ে।
অর্থাৎ, তাঁহার তত্ত্ব একাধারে অবাধ ভোগবাদের কঠোর সমালোচক, আবার রাষ্ট্রীয় গা-জোয়ারিরও সমান বিরোধী। অবস্থানটির গুরুত্ব অপরিসীম। ক্রেতা যাহা চাহেন, তাহাই শ্রেষ্ঠ, এবং সেই চাহিদাই শেষ অবধি সমাজকে সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থানে পৌঁছাইয়া দিবে, মুক্তবাণিজ্য-পন্থীদের এই অলীক বিশ্বাসটিকে যেমন খণ্ডন করিয়াছেন, তেমনই সর্বাধিপত্যকামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকেও বিপজ্জনক হিসাবে দাগিয়া দিয়াছেন। তিনি বাজারপন্থী, কিন্তু বাজারের অদৃশ্য হাতের উপর অহেতুক ভরসা তাঁহার নাই। তাঁহার অবস্থানটি সূক্ষ্ম এবং জটিল। মোদী-ট্রাম্পের যুগে প্রভূত তাৎপর্যপূর্ণও বটে। রাষ্ট্র কী পারে আর কী পারে না, তাহার এক্তিয়ার কতখানি, থেলারের দর্শনে সেই সীমারেখাগুলি অতি স্পষ্ট। স্মর্তব্য, তাঁহার দর্শনে নিয়ন্ত্রণবাদের জায়গা যতখানি, উদারপন্থার জায়গা তাহার তুলনায় তিলমাত্র কম নহে। আদিত্যনাথরা যে তাঁহাকে চিনিবেন না, তাহাতে আশ্চর্য কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy