এখন কোথায় জেগে উঠব একা? হয়তো একা নই, আরও মানুষ জেগে উঠছে...’: কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের (‘জেগে উঠেছি’) হয়তো ক্ষীণ আশা ছিল, আরও অনেক জেগে ওঠা মানুষের গলার শব্দ শোনা যাবে। কিন্তু, ২০২০ হয়তো একা মানুষদের সে আশায় জল ঢেলেছে। আপাতদৃষ্টিতে এই মড়কের কালে, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার হাত ধরাধরি করে এসেছে নিঃসঙ্গতাও। ছবির পর ছবি তার প্রমাণ।
চিত্র এক: চলতি মাসের গোড়ায় ইংল্যান্ডের ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্স’ ও ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস’-এর দু’টি সমীক্ষার ফল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দেখা যাচ্ছে, প্রথম সমীক্ষায় ৫৭ শতাংশ ও দ্বিতীয়টিতে ৫২ শতাংশ পড়ুয়া বলছেন, কোভিড-পরিস্থিতিতে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে।
চিত্র দুই: কোভিড-আক্রান্ত অমিতাভ বচ্চন এক পোস্টে লিখেছিলেন, “চোখ ভিজলেও মুছিয়ে দেওয়ার মতো কোনও হাত আমার পাশে নেই। একা থাকার এই ভয়, হতাশা মনে ক্ষত তৈরি করতে পারে যে কোনও সময়।”
চিত্র তিন: গত এপ্রিলের শেষ লগ্নে কাজ হারিয়ে অন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে পশ্চিম বর্ধমানের ডুবুরডিহিতে সীমানা লাগোয়া জঙ্গলের পাকদণ্ডী বেয়ে ঝাড়খণ্ডে ২ নম্বর জাতীয় সড়কে ওঠেন বিহারের সমস্তিপুরের বাসিন্দা রাম পাসোয়ান (নাম পরিবর্তিত)। সাইকেল সঙ্গী করে বাড়ি ফিরছেন তিনি। পেডালে পা দেওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের এক বেসরকারি ইস্পাত কারখানার একদা ওই ঠিকাকর্মী হিন্দিতে বলেন, ‘‘এখানে আর কাজ নেই। বড্ড একা লাগে, তাই গ্রামে চললাম।’’
চিত্র চার: অনুভবটি গড়পড়তা, হয়তো বা ব্যক্তিগতও। আমাদের চার পাশে এমন অনেকেই থাকেন, যাঁরা সম্পূর্ণ একা। নিঃসঙ্গতা তাঁদের কাছে আনন্দ-অহঙ্কারের। কিন্তু, সমাজজীবনকে আলগোছে ভালবাসেন তাঁরা। ২০২০-র স্তব্ধতার বছর সেই ভালবাসা থেকে মানুষগুলিকে বিযুক্ত করে দিল। তাঁরা একা, এই বোধটাই চেপে বসল। যা ছিল অহঙ্কারের, তা-ই হল মনখারাপের। দীর্ঘকালের ভাল লাগা কাজগুলিও ক্রমে অপ্রিয় হয়ে উঠল। প্রধানত মধ্যবিত্ত সমাজের এই মানুষগুলি সমাজে সংখ্যালঘু। তাই, সমাজকেও ‘আশ্রয়হীন’ মানুষগুলিকে ভুলে থাকার যেন অধিকার দিল এ বছর! ফল, দেখা গেল অসুস্থতা,আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ।
এই চারটি ছবির চরিত্রদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান আলাদা। ২০২০-তে এঁদের মিলিয়েছে একটিই শব্দ, নিঃসঙ্গতা। প্রথম ক্ষেত্রে, ভার্চুয়াল পরিধির বাইরে ক্লাস না করতে পারা, কখনও বা ভার্চুয়াল জগৎ থেকেই বিযুক্তি, সহপাঠীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা এর অন্যতম কারণ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, সমাজের সর্বোচ্চ স্তরের বাসিন্দা হয়েও এক ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ফুটে উঠছে। তৃতীয় ক্ষেত্রে, কর্ম-বিচ্ছিন্নতা ও শেষ ক্ষেত্রটিতে একা মানুষের আত্মবিচ্ছিন্ন ছবি দেখা যাচ্ছে। নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা শব্দ দু’টি আভিধানিক অর্থের নিরিখে হয়তো খানিকটা আলাদা। কিন্তু এ দু’টির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এমনকি, দু’টির প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সম্পর্কশূন্য’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে অভিধানেই।
এই নিঃসঙ্গতা, সম্পর্কশূন্যতা বা বিচ্ছিন্নতা নিয়ে দার্শনিক-সমাজবিজ্ঞানীরা তো অনেক ভেবেছেন। রুসো, কান্ট, হেগেল, লুডউইগ ফয়েরবাখরা বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেছেন। কার্ল মার্ক্স তাঁর ‘থিয়োরি অব এলিয়েনেশন’-এ প্রকৃতি, স্ব-কর্ম, প্রজাতি ও অন্য মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বটি সামনে এনেছিলেন। আবার কিয়ের্কগার্ডের অস্তিত্ববাদী দর্শনে মানুষের জীবনধারণের উপায়গুলির সঙ্গে নানা ‘অস্তিত্বলোপী বাধা’র খটাখটি লেগেছিল। এই বাধাগুলির মধ্য দিয়েই আসে বিচ্ছিন্নতা। নানা পর্ব পেরিয়ে আমেরিকান চিন্তাবিদ মেলভিন সিম্যান পাঁচটি কাঠামোর মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্নতার অর্থটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন ১৯৫৯-এ, তাঁর ‘অন দ্য মিনিং অব এলিয়েনেশন’ শীর্ষক কাজটিতে।
২০২০-তে ছাত্রছাত্রীদের নিঃসঙ্গতার যে বিষয়টি, তা যেন সিম্যান কথিত ‘মিনিংলেসনেস’-এর প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ পড়ুয়ার যা কাজ, পড়াশোনা, সেটা তাঁরা করছেন। কিন্তু, এক যান্ত্রিক উপায়ে। কর্মের সঙ্গে তার আত্মীকরণ গড়ে উঠছে না। ফলে, ‘অর্থহীনতা’ তাকে গ্রাস করছে। সেখান থেকেই জন্ম হচ্ছে তাঁদের নিঃসঙ্গতার অনুভূতি। ঘটছে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি। আবার অন্য ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গতা এক ধরনের ‘ক্ষমতাহীনতা’র আক্ষেপ। আবার যে পরিযায়ী শ্রমিকটির কথা বলা হয়েছে, তাঁর অনুভূতির মধ্যে ক্ষমতাহীনতার সঙ্গে মিশে আছে বিচ্ছিন্নতার বিষয়টিও। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজের মনোজগৎ ও শ্রম-সত্তার সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষ চলছে তাঁদের। তা ছাড়াও আছে ব্যক্তিমানুষের মধ্যে আত্ম-বিচ্ছিন্নতার বোধ— সেটাও বাড়িয়ে দিয়েছে এ বছরের সামাজিক অবস্থা। ব্যক্তিমানুষের অন্তর্লীন চাওয়া-পাওয়ার ধারণার সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীর খাপ না খাওয়া দেখে আমেরিকান দার্শনিক রিচার্ড শ্যাস্ট বলেছিলেন, এটাই মনোজগতে ‘বিপর্যয়’ ও এর জেরে তৈরি হওয়া আত্ম-বিচ্ছিন্নতা।
মোটের উপর, আমাদের এটা মনে হতেই পারে, ২০২০-র বছরে মানুষ আরও নিঃসঙ্গ হল, কিংবা নিঃসঙ্গতার মানবিক ইতিহাসটি আরও খানিক এগিয়ে গেল। ঘটনাচক্রে, এই আলোচনা থেকে এটা মনে হতেই পারে, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে এক ধরনের নেতির ধারণা যুক্ত। কিন্তু সব সময়েই কি তাই? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিঃসঙ্গতা নিয়ে একটি বিশিষ্ট দর্শন ছিল। সে দর্শনও একমুখী নয়। কিন্তু তিনি তাঁর পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আলোচনায় বাবার মধ্যে এক ধরনের ‘চিত্তের প্রশান্তি’ দেখেছিলেন, যা সমাজ-সংসারের কোনও উপাদানই ক্ষুণ্ণ করতে পারত না। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘অফুরন্ত শান্তির উৎসের সন্ধান’ পাওয়ার কারণেই দেবেন্দ্রনাথ এমন ‘নিঃসঙ্গতা ও স্বতন্ত্রতার অধিকারী’। (‘ব্যক্তি প্রসঙ্গ’) সুতরাং, এ ক্ষেত্রে কিন্তু নিঃসঙ্গতা এক দার্শনিক উপলব্ধি।
২০২০-র নিঃসঙ্গতা কি সে দর্শনবোধে পৌঁছল? কে জানে, হয়তো এই ধরনের উপলব্ধি থেকেই বেশ কিছু সঙ্গীত, সাহিত্য বা দর্শনের জন্ম হল। সেগুলির কোনওটা ইতিমধ্যে প্রকাশিত, কোনওটা নয়। এ সবই হয়তো আগামী বছরের নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ দেবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy