টেনিদা বলিয়াছিলেন, তাঁহাদের কলেজ খুব ভাল, ছটপূজাতেও ছুটি দেয়। টেনিদা সম্ভবত গত হইয়াছেন, তাই তাঁহার কলেজের অভ্যাস যে কী ভাবে আপামর বাঙালির অধিগত হইতেছে, দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। বাঙালির মুখ্যমন্ত্রীর কৃপাদৃষ্টিতে এই রাজ্যে এখন ছুটির মধ্যে মাঝে মাঝে কর্ম-অবসর হয়, ছটপূজার ছুটিও এ বার সেই তালিকায় যুক্ত। এই বিশেষ পূজাটি ঠিক বাঙালির পূজা নয়, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের উৎসব। তাই এত দিন ইহা এ রাজ্যে ‘সেকশনাল’ ছুটি হিসাবে গণ্য হইত, অর্থাৎ রাজ্য সরকারের যে অংশের ইহা ন্যায্যত প্রাপ্য, তাহাদের জন্যই ইহা ধার্য ছিল। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকার হয়তো মনে করিতেছে, বসুধৈব কুটুম্বকম্ বলিয়া ছুটিরও আপন-পর ভেদাভেদ রাখিতে নাই, আমরা-ওরা করিয়া ছুটির সুযোগ নষ্ট করিতে নাই। তাই ছট পূজার ‘সেকশনাল’ ছুটিকে এক আঁচড়ে ‘জেনারেল’ বা সাধারণ ছুটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। এতদ্দ্বারা তৃণমূল সরকারের কার্যকালে বর্ধিত সাধারণ ছুটির সংখ্যা দশ ছাড়াইল। ক্রমে হয়তো তামিল বা নাগা উৎসবও এ রাজ্যের তালিকায় ঢুকিয়া পড়িবে, ও শীঘ্রই সংখ্যাটি এক-কুড়ি ছাড়ইয়া অর্ধশতের দিকে হাঁটিবে। মানুষকে খুশি করিবার এই পদ্ধতিটি কার্যকর, সন্দেহ নাই। দিবানিদ্রা বাড়িলে ভোটও বাড়ে, এ হিসাব হয়তো ভুল নয়। একটিই আশঙ্কা। এই গতিতে ছুটি বাড়িলে কেবল স্বল্পমেয়াদের খুশির রমরমা হইবে না তো? কর্মসংস্কৃতির হাল মন্দ হইলে কর্মসংস্থান, উন্নয়ন তলানিতে ঠেকিলে দীর্ঘমেয়াদের খুশিটি কমিবে না তো?
সরকারি যুক্তিবাদীরা যুক্তি দিবেন, কেন, বাম ফ্রন্ট আমলে কথায় কথায় বন্ধ-এর কারণে যে সব কর্মদিবস নষ্ট হইত, বর্তমান সরকার কি তাহা হইতে জাতিকে বাঁচায় নাই? যুক্তিটি আংশিক যথার্থ। সত্যই বাম আমলের সেই ট্র্যাডিশন আজ অনেকাংশে বিগত। সেই হঠাৎ-পাওয়া ছুটি, দ্বিপ্রাহরিক আড্ডা ও পাড়ার মোড়ে ক্রিকেট-বিহারের আনন্দ হইতে বাঙালি আজ অনেকটাই বঞ্চিত। কুলোকে বলে, বন্ধ নিষিদ্ধ করিবার সিদ্ধান্তের ছুটিবঞ্চনার দুঃখ লাঘব করিতেই এই ভাবে অন্যবিধ ছুটি বাড়াইবার তাড়না। আরও একটি যুক্তি, রাজ্যে কর্মসংস্কৃতি যথেষ্ট উন্নত হইয়াছে, তাই ছুটি বাড়াইলে ক্ষতি নাই। মানুষ খুশিমনে কাজ করিবে। ইহার একটিই উত্তর। সংখ্যা বস্তুটি তুচ্ছ, মানসিকতাই আসল। মানুষ যদি তুচ্ছ উপলক্ষে কাজ না করিবার মানসিকতাটিতে অভ্যস্ত হয়, সমাজের উপকার হইতে পারে না।
ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দাদের উৎসবকে মান্যতা দিবার মধ্যে একটি মহত্ত্ব আছে, এই দাবিটি এখনও প্রকাশ্যে শোনা যায় নাই বটে, তবে আন্দাজ করা চলে, অন্দরমহলে এমন একটি আত্মগর্বের ঠাঁই হইতেছে। মান্যতার কিন্তু নানা রকম অর্থ হয়। নানা ভাষা নানা সংস্কৃতির এই দেশে সকলকে মান্যতা দিয়া সকলের ছুটির সংখ্যা বাড়াইয়া চলার এক রকম অর্থ। আর ছুটি ব্যতিরেকেই ভিন্ সংস্কৃতির পোষণ করার আর এক রকম অর্থ। দেশের অন্যান্য রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতিকে মনে করিয়া অনুষ্ঠান আয়োজন, সচেতনতা বৃদ্ধি, কর্মপ্রকল্প তৈরি, সাহিত্য অনুবাদের চেষ্টা, এইগুলিও ভাবা যাইতে পারে। কেবলমাত্র পূজার আয়োজন ও তন্নিহিত ছুটির মধ্যেই সংস্কৃতির সমস্ত দিশা খুঁজিয়া চলা কেবল বোকামি নয়, বিপজ্জনক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy