চোদ্দো বছরে বিধবা হওয়া ইস্তক থান পরতে হত মেদিনীপুরের মেয়েটিকে। বিধবা হওয়ার পর প্রথমে শ্বশুরবাড়ি চেষ্টা করে তাঁকে সোনাগাছিতে বিক্রি করে দিতে, তার পর বাপের বাড়িতে ফিরে গেলে দোজবরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সাল ১৯৪৩। পাড়হীন শাড়িতে বিষণ্ণ, মাইতি-বাড়ির মেয়েটির জীবন এক দিন আমূল বদলে যায়। না, সিঁথির সিঁদুরের মহিমায় নয়; রঙিন শাড়ি পরিয়ে তাঁকে কর্মযজ্ঞে টেনে আনেন বরিশাল থেকে মেদিনীপুরের গ্রামে গ্রামে রিলিফ কেন্দ্র চালু করতে আসা ভারতের বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মণিকুন্তলা সেন।
মেয়েটি বাস ধরে চলে যান তমলুক। পায়ে হেঁটে চষে ফেলেন গ্রামের পর গ্রাম, যেখানে আগের বছরেই অগস্টে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের পর সাইক্লোন ও বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে। সেই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার আগেই কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কবলে মানুষ দিশাহারা। সর্বত্র ঘুরে মিল্ক-ক্যান্টিন আর মেডিক্যাল রিলিফের কাজ শেখেন মেয়েটি, জেলায় জেলায় যা শুরু করেছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী মেয়েদের মঞ্চ হিসেবে যুদ্ধের সময় গড়ে-ওঠা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। অনেক রিলিফ কেন্দ্রের দায়িত্ব পান অল্পবয়সি মেয়েটি— তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী বিমলা মাজী।
বিমলার প্রায় সমবয়সি আরও অনেক মেয়ে যুক্ত হন এই কাজে। শিবিরগুলো চালানোর জন্য তাঁদের লেখাপড়াও শেখানো হয়। সেই সঙ্গে চলে মাদুর ও বেতের জিনিস বোনার কাজ, যাতে ‘ত্রাণ’-এর সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে, লক্ষ্য হয় স্বনির্ভরতা।
তেভাগায় বিমলা মাজী ও তাঁর সতীর্থদের ভূমিকা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু তাঁর মতো আরও অসংখ্য মেয়ের, সমাজ-নির্দিষ্ট কিছু ছক ভেঙে রিলিফের কাজের মধ্যে শামিল হওয়ার ইতিহাসটা চাপা পড়ে গিয়েছে বলা যায়। অথচ গণনাট্য সঙ্ঘ এবং তেভাগা আন্দোলনের অনেক কর্মীই রাজনীতিতে এসেছিলেন মন্বন্তর-বিরোধী কাজের সূত্রে। যেমন, ১৯৪৩-৪৪’এ রিলিফ আদায়ের জন্য রংপুরের মেয়ে রেবা রায়চৌধুরী সেখানকার গ্রামেগঞ্জে মিছিল ও পথসভা করে বেড়াতেন। তখন তিনি ১৭-১৮ বছরের। মিছিল-সভাগুলি শুরু হত তাঁর কণ্ঠে হরিপদ কুশারী ও অন্যান্যদের লেখা মন্বন্তরের গান দিয়ে।
গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে বহু পারিবারিক-সামাজিক বাধা ডিঙিয়ে তাঁদের অসাধারণ গান-নাচ-নাটকের মধ্য দিয়ে বাংলার জন্য রিলিফের টাকা তুলতেন সারা দেশ ঘুরে। তাঁদের সেই সাংস্কৃতিক কাজের কথা আমরা কিছু কিছু জানি। কিন্তু শ্রেণি-লিঙ্গের স্টিরিয়োটাইপ ভেঙে রিলিফের কাজে আত্মরক্ষা সমিতির মেয়েদের ভূমিকা আমরা এখনও সে ভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি। যেমন, রাত তিনটের ট্রেনে গ্রাম থেকে দলে দলে যে নারী-পুরুষ বালিগঞ্জ স্টেশনে এসে নামতেন চালের লাইনে দাঁড়াবেন বলে, সমিতির মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাজ ছিল ভোরবেলা থেকে তাঁদের পাশে থাকা, সকালে তাঁরা যাতে ন্যায্য মূল্যে চাল পান সেটা দেখা, কমবয়সি মেয়েদের আশেপাশে দালাল ঘুরছে কি না খেয়াল রাখা, কেউ মরা শিশু কোলে নিয়ে বসে থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা করা—এই সব আর কী! গ্রামে গ্রামে পথের ধারে পড়ে থাকা শবদেহগুলোকে শেয়াল-শকুনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সাফাইকর্মীদের পাড়া ও ডোমপাড়ায় গিয়ে ব্যবস্থাও করতেন। ভদ্রোচিত (ভদ্রমহিলা-উচিত) কাজ বলে এগুলো একেবারেই গণ্য হত না!
পঞ্চাশের মন্বন্তরে বহু সমাজসেবামূলক ও ধর্মীয় সংস্থা বাংলার নিরন্ন মানুষকে অন্ন ও বস্ত্র জোগিয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই প্রয়াস ছিল সম্পূর্ণ নারীবর্জিত। দু’-একটি নারী সংস্থা, যেমন নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন (এআইডব্লিউসি), অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম খুলে অথবা খাদি কেন্দ্র শুরু করে নিবিড় ভাবে দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের পাশে থেকেছে। কিন্তু তাদের কাজের ধরন ‘নারীসুলভ’ ছিল বলে, তাতে সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান ছিল। সে কাজের ফলে শ্রেণি-লিঙ্গের স্টিরিয়োটাইপ ভাঙার আশঙ্কা ছিল না।
কথাটা এই জন্য বলছি যে, বিশেষ করে ভদ্রমহিলাদের শ্রেণি-নির্দিষ্ট কিছু আচার-আচরণ মেনে চলতে হত। রাস্তায় সবার সঙ্গে প্রকাশ্যে মেলামেশা, বুভুক্ষু মানুষের জন্য পথসভায় গান গেয়ে টাকা তোলা, অন্য শ্রেণির মেয়েদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে চালের দোকানিদের প্রয়োজনমতো হুঁশিয়ার করা— ভদ্রসমাজে মানানসই নয়। ‘নারীত্ব’-এর মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া এমন সব কাজ করার ফলে আত্মরক্ষা সমিতির মেয়েদের নামে হামেশা রটত কুৎসা; গঞ্জের এ দিক ও দিক পোস্টার পড়তেও দেরি হত না। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক আপত্তিই এত প্রবল ছিল যে, মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হত এক কাপড়ে।
ইদানীং আমরা কমিউনিটি কিচেন বা ক্যান্টিন, গণ-উদ্যোগে রেশন বিলি— কথাগুলো শুনেছি। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ বহু কাজ-খোয়ানো মানুষের পাশে অতিমারির সময় যখন রিলিফ সংগঠিত করছে, তখন পরিকল্পনা-পরিচালনা ও নানা ভূমিকায় মেয়েদের অংশগ্রহণ চলছে। তাই বদলটা কী ভাবে এসেছিল মনে রাখা জরুরি।
আত্মরক্ষা সমিতির মেয়েরা জেলায় জেলায় নিরাশ্রয় দুর্গতদের পুনর্বাসন দেওয়ার কাজ যেমন করতেন, তেমনই দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য সমিতির উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে-রাঁধা খিচুড়ির ক্যান্টিন ছিল। সেগুলোর দায়িত্বে মধ্যবিত্ত বাড়ির বয়স্ক গৃহিণীরা থাকতেন। তাঁরা অনেকেই নিজেরাও বেশ কিছু সংস্কার ভাঙছিলেন। যেমন, একডালিয়া রোডের নলিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে চলত এ রকমই ক্যান্টিন আর বয়স্ক মেয়েদের সাক্ষরতার ক্লাস। তাঁর পুত্রবধূ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পী হিসেবে অভিনয় করতে নানা জায়গায় যেতে হত, কখনও রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে হত। সেই প্রথাবহির্ভূত কাজে নলিনীর পূর্ণ সহযোগ ছিল।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজের আরও একটা খুব বড় দিক ছিল রেশন ব্যবস্থা ও কন্ট্রোলের দোকান খোলার জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার আন্দোলন। খাদ্যসঙ্কট, কালোবাজারির দিনে রাষ্ট্র-প্রশাসনকে খাদ্য সরবরাহ করতে বাধ্য করার কাজটাও এই মেয়েরাই প্রথম করেছিলেন। চালের দাম কমানো ও রেশন দোকান খোলার দাবিতে আত্মরক্ষা সমিতি ও মুসলিম মহিলা আত্মরক্ষা লিগ-এর নেতৃত্বে ১৯৪৩-এর ১৭ মার্চ শহর-গ্রামের পাঁচ হাজার মেয়ের একটি মিছিল বাংলার আইনসভায় পৌঁছেছিল। মেয়েরা আঁচলে বাঁধা পয়সা দেখিয়ে ন্যায্য মূল্যে চাল কিনতে চেয়েছিলেন— যে দামে তাঁরা চাল কিনতেন মজুতদারি শুরু হওয়ার আগে। এই অভূতপূর্ব জমায়েতের ফলে সে দিন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সদস্যরা কয়েক লরি বোঝাই চাল আনিয়ে উপস্থিত প্রত্যেককে দু’সের চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সে দিন মেয়েরা সরকারের থেকে ন্যায্য দরের চালের দোকান খোলার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। কিছু দিন পর সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতায় ১৬টি চালের দোকান এবং কতকগুলো বড় ক্যান্টিন খোলা হয়।
আজ আমরা খাদ্য নিরাপত্তা আইন পেয়েছি, কিন্তু লকডাউনের ফলে ডিলার-নির্দিষ্ট রেশন কার্ডের দরুন দেশের নানা প্রান্তে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্যাভাবে হয়রান হতে হয়েছে। এক দেশ এক রেশন কার্ডের কথাও শুনছি, যার ঝঁুকিও যথেষ্ট। যেন ভুলে না যাই যে, বাংলার মন্বন্তরের সময়েই, ১৯৪৫ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রথম চালু হয় এবং তারও আগে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ‘ভুখ মিছিল’ কলকাতার বুকে প্রথম রেশন দোকানগুলো চালু করতে প্রশাসনকে বাধ্য করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy