রূপকথার বিয়ের গল্প শুনলাম আমরা। এক রাজপুত্র বিয়ে করল সুন্দরী রাজকন্যাকে। হীরে চুনি পান্না বসানো তাদের পোশাক, তাসকানি না কোথায় বেগুনি গোলাপি ফুলের লতা ঘেরা তাদের বিয়ের প্রাসাদ, সামনে নীল টলটলে জলের দিঘি, ফোয়ারা উপচানো সুখ।
ও মা, কী কাণ্ড! ঠিক তার আগের দিনই সেই রাজপুত্র-রাজকন্যার দেশেরই তো ঘটনা। লখনউয়ের পনেরো বছরের একটি মেয়ে। ব্লাড ক্যানসার অসুখ তার, গত পাঁচ বছর ধরে। তাতে কী? সেও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখে, রাজপুত্র আসবে পক্ষিরাজে চেপে। যেমন স্বপ্ন আমাদের সব মেয়েকে দেখতে শেখানো হয়। বড় হতে হতে আমরা বুঝেছি, এমন স্বপ্ন দেখতে নেই। আর মেয়েটি বুঝে যায় বড় হওয়ার আগেই। সে বাজারে পরিচিত এক জনকে দেখতে পেয়ে তার সঙ্গে বাড়ি আসবে বলে রওনা হয়। হয়তো চেনা লোককে দেখে ভরসা পেয়েছিল। তবে বাস্তবটা তো ঠিক ভরসা করার জায়গা নয়, তাই লোকটি মেয়েটিকে নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে, আর এক জনের সঙ্গে মিলে, ধর্ষণ করে।
বাস্তবকেও লজ্জা দিয়ে, ঘটনা এখানে শেষ হয় না। পনেরো বছর বয়স তো, তাই বিশ্বাসটা এর পরেও ভাঙে না। মেয়েটি জ্ঞান ফেরার পর, তারই পাড়ায় থাকা পরিচিত এক জনকে বাইকে চেপে যেতে দেখে, সাহায্য চায়। সেও ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায় মেয়েটিকে। মেয়েটির দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য, সে মারা যায়নি। তবে সকালে পুলিশ যখন তাকে খুঁজে পায়, তার জ্ঞান ছিল না।
তবু ওই মেয়েটির ভাগ্য হরিয়ানার পাঁচ বছরের মেয়েটির থেকে বোধহয় ভাল। যে তার মা আর দিদির পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে দু’জন। নির্ভয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাদের অত্যাচারে, অন্ত্র ও জরায়ু ফুটো হয়ে মারা যায় পাঁচ বছরের শিশুটি। মেয়ে হয়ে জন্মানো, না গরিব পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মানো, কোনটা অপরাধ?
রূপকথার বিয়েতে কেমন সব কিছু ছিল। গয়নাগাটি, জামাকাপড় তো ছিলই, কেমন হাসি-হাসি মুখে বিয়ে করতে বর এসেছিল। কিন্তু পাওনাগন্ডা মেলেনি বলে এই দেশে বিয়ের আসর ছে়েড় চলে যায় অনেক বর। কেরলের রেমিয়া রামচন্দ্রন বা রাজস্থানের রাশি সাক্সেনারা পণের দাবি মেটাতে না পেরে তাঁদের পরিবারের অপমান দেখে বিয়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। গয়নাগাটি টাকাপয়সা পছন্দ হয়নি বলে অত্যাচারের কথা আর নতুন করে বলি না আমরা। প্রতি দিন ভারতে পণের দাবির জন্য মৃত্যু হয় ২১ জনের। এখন আবার বিয়ের পরে চাকরি করেও টাকা আনতে হবে। না হলে মুশকিল। এই তো পারমিতা বক্সী আর অনন্যা কোনার সাঁইকে আত্মহত্যা করতে হল এই জন্য।
তবে এ সব দুঃখের ঘটনা ঘটবে বলে কি রূপকথার বিয়ে আটকে থাকবে? আমরা আর এক বার কোমর বেঁধে বাড়ির কিশোরী কন্যাটিকে স্বপ্নও দেখাতে পারব। দেখ, তেমন ভাগ্য ভাল থাকলে এখনও রূপকথারা সত্যি হয়। ভাল করে স্কিনের যত্ন নে, স্লিম থাক— দেখবি ঠিক এক দিন তোরও...
রূপকথার বিয়েতে অসুবিধে নেই, অসুবিধে এই বিশেষ ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে গল্প শোনানোয়। কিশোরী কন্যাসন্তানকে ছোটবেলা থেকে বিয়ের স্বপ্ন দেখানো, বা আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে, বড়লোক বরের স্বপ্ন দেখাতে বাকি রাখেন ক’জন মা? যদি কেউ দু’কামরার ফ্ল্যাটে থাকেন, মেয়েকে অন্তত চার কামরার ফ্ল্যাটে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করেন। আপনি বলবেন, সন্ততিকে স্বপ্নে রাখার, তাকে দুধেভাতে রাখার চেষ্টা। হতেও পারে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেই সর্বগ্রাসী লোভেরই উত্তরাধিকারচর্চা বই তো নয়। ভাবটা এমন, আমারও লোভ ছিল জারদৌসি শাড়ির, আমি ব্লক প্রিন্ট অবধি যেতে পেরেছি। আমার মেয়ে যেন জারদৌসি অবধি যেতে পারে।
মা হয়ে মেয়ের ভালর জন্য লোভ করা কি খারাপ? না হয়তো। কিন্তু এই লোভ চারিয়ে যায় মেয়েটির মধ্যেও। লোভের হাতছানিতে বাড়ি ছেড়ে, মাকে ছেড়ে, রওনা দিতে চায় রূপকথার উদ্দেশ্যে। দিল্লি থেকে ষোলো বছরের যে মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনে পুলিশ, সে প্রেমের ভরসাতেই বাড়ি ছেড়ে ভয়ংকর বিপদে পড়েছিল। শুধু যে গরিব বাড়ির, অল্পশিক্ষিত মেয়েরা এই চক্রে পড়ে তাও নয়। আমরা ক’জন বাড়ির বাচ্চা মেয়েটিকে বলি, তুই কবে চাকরি করে বড় বাড়ি করবি, আমরা গিয়ে থাকব? ক’জন তাকে আশ্বস্ত করি যে তুই যেমন আছিস— রোগা মোটা কালো ফরসা— তেমনই থাক? বিয়ে করতে হবে, কে মাথার দিব্যি দিয়েছে?
রেনবো প্রাইড মার্চের ইনভিটেশন আসে আমাদের কিশোরী কন্যা (বা পুত্রের) কাছে। আমরা ক’জন খুশি হয়ে হ্যাঁ বলি? কে জানে বাবা, লোকে যদি আমার মেয়ের সম্পর্কেও ‘তেমন কিছু’ ভাবে। আমাদের মাথায় সেই রূপকথার লোভ। আমাদের সন্তানরাও বলে না, ‘অন্য কিছুর গল্প বলো’, আমরাও ভাবতে শেখাই না, রাজকন্যা রাজপুত্রদের এত আছে, পারমিতা রেমিয়াদের কিছু নেই কেন? অনেকের এত বেশি থাকে কেমন করে? ওদের অত বেশিতে আমরা হ্যাংলার মতো, বোকার মতো খুশি হচ্ছি কেন? আর যাদের আমাদের থেকেও কম আছে— তাদের কথাই বা ভাবতে ভুললাম কোন মেয়ে-ভোলানো গল্পের বশে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy