প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। ফাইল ছবি
নির্বাচন আসে যায়। নতুন সরকার গঠন হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর কোনও আমূল পরিবর্তন হয় না। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবারও মোদি-শাহ জুটি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। এই চমকপ্রদ নির্বাচনের ফল অনেক অর্থনীতিবিদকে বিস্মিত করেছে। সাধারণ মানুষের নোটবন্দির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, তড়িঘড়ি জিএসটি রূপায়ণের ফলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের করুণ পরিস্থিতি, কালো টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যর্থতা ও সর্বোপরি বিপুল বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে এই জনাদেশ সত্যিই বিস্ময় জাগায়। তা বলে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনাদেশ কে অসম্মান করার কোনও কারণ নেই। হয়তো পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে (তা সে ঠিক হোক বা ভুল) প্রাধান্য দিয়েছেন ও কুর্ণিশ জানিয়েছেন ভারতীয় জনগণ। নির্বাচনের ঠিক আগে পুলওয়ামা ঘটনা ও দেশপ্রেমের আবেগও হয়তো ইভিএমে প্রতিফলিত হয়েছে। আর সঙ্গে দোসর হিসেবে সহায়ক ছিল গণমাধ্যমের একাংশ। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবান কর্পোরেট গোষ্ঠীর স্নেহের অদৃশ্য হাতও থাকতে পারে নির্বাচনী এই সাফল্যের পিছনে।
সাফল্যের পেছনে যাই যুক্তি থাকুক না কেন এ কথা ধ্রুব সত্য যে অর্থনীতির পরিভাষায় কারণ ও ফলের (cause and effect) বাস্তবে সরলীকরণ করা কঠিন। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে বিপুল সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত হয় গগনচুম্বী প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা। আর এই প্রত্যাশার পারদ আগামী পাঁচ বছর উত্তরোত্তর বাড়বে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হবে। আসুন দেখে নেওয়া যাক অর্থনীতির সেই চ্যালেঞ্জগুলি।
চ্যালেঞ্জ ১: কেন্দ্র সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সময়ে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। ভারতবর্ষে গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের হার কখনও ৬.২ শতাংশ হয়নি। ওই রিপোর্টই বলছে, প্রায় ৭৫ শতাংশ কর্মদক্ষ ভারতীয় কর্মহীনতায় ভুগছেন। তাদের ঠিক কর্মসংস্থানের কোনও দিশা নেই। এই বিশাল সংখ্যার তরুণ-তরুণীদের কাজের সুব্যবস্থা করে দেওয়া ও অর্থনীতির মূল স্রোতে জায়গা করে দেওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ এই নতুন সরকারের কাছে। শুধু পরিষেবা ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে এই বিপুল বেকারত্বের হার কমানো সম্ভব নয়। সময়পোযোগী শিল্প ও নতুন কলকারখানা তৈরির মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। বিশ্ববাজারের চিন-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির তুলনা মূলক সস্তা জিনিসপত্র, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আমাদের দেশের পণ্যের বাজারকে অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছে। কী ভাবে ও কী করলে দেশিয় পণ্যের চাহিদা বাড়বে হয় তা ভেবে দেখতে হবে। বাজেটে করযুক্ত আয়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ও কর ব্যবস্থার সরলীকরণ একটি অন্যতম পন্থা হতে পারে। আবার অন্য দিকে, সঞ্চয়ের ক্ষেত্র ও সীমা বাড়িয়ে সুদূরপ্রসারী বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করার মধ্যে দিয়েও অর্থনীতির উন্নয়নের গতি আনা সম্ভব।
নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি রাতারাতি হয়ত সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যূনতম আয় যোজনার দিকগুলি ভেবে দেখতে পারেন। অন্যান্য আর্থসামাজিক প্রকল্পের পাশাপাশি, এই ন্যূনতম আয় যোজনা চালু করা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হতে পারে। এতে আয় ও সম্পদের বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এই ন্যূনতম আয় যোজনা একটি তাৎক্ষণিক সমাধান। তাই সব সময়ে নজরে রাখতে হবে নতুন কর্মসংস্থানের পেক্ষাপট তৈরির জন্য।
চ্যালেঞ্জ ২: আমাদের দেশ কৃষিক্ষেত্র এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি তীব্র অসন্তোষে কৃষকদের বিশাল মিছিল মাঠ ছেড়ে রাজপথে নেমে এসেছে। নজরে এসেছে বহু কৃষকের আত্মহত্যার করুণ কাহিনি। তাই এক সংবেদনশীল রাষ্ট্রশক্তি কৃষকদের এই দুর্দশার দিকগুলি অনুসন্ধান না করা ও যথাসাধ্য সমাধান থেকে বিরত থাকা কখনই উচিত হবে না। আর ভুলে গেলে চলবে না, কৃষি সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত থাকে খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্ন।
গত বছরগুলিতে কৃষিক্ষেত্রে উপাদানের ব্যয় যথেষ্ট ঊর্ধ্বমুখী। সারের দাম, সেচের খরচ, ফসলের বীজের দাম— প্রায় সব উপাদানের খরচ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় ফসলের দাম খোলাবাজারে খুব একটা বাড়েনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের যে ন্যূনতম ফসলের দাম (অর্থাৎ মিনিমাম সার্পোট প্রাইস) ঘোষণা করে তা যৎসামান্য। এর ফলে ফসলের দাম ও ফসল উৎপাদনের খরচের মধ্যে একটি অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। তাই এই উৎপাদিত ফসলের দাম ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্য কৃষক ঋণ নেন। এটি বিশেষ করে প্রান্তিক চাষি ও ভাগচাষিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আবার নানা ক্ষেত্রে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ফসল নষ্ট হয়। বহু ক্ষেত্রে চাষি তাঁর ফসলের বীমা করে উঠতে পারেন না। উপরন্তু ফসল বীমা করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন চাষি। কৃষিক্ষেত্রে এই অবস্থার জন্যই কৃষক ঋণ নেন যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনাদায়ী থেকে যায়। আর এই অনাদায়ী ঋণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলির উপরে চাপ বাড়ে। কৃষিক্ষেত্রের এই প্রতিকূলতার থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট কৃষক-দরদী কৃষিনীতি। এই ক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে দিশা দেখাতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ৩: প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার ও মূল্যায়ন এই যুগে প্রায় প্রত্যেকটি প্রগতিশীল দেশের কাছে চ্যালেঞ্জ। এক দিকে, শুধু মুনাফা কেন্দ্রিক কর্পোরেট সংস্থার গ্রাস প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে পড়ছে, অন্য দিকে, অত্যাধুনিক স্মার্টসিটির খপ্পরে পড়ে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। যা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের জলসঙ্কট ও উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাকৃতিক বিপর্যয় নতুন করে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের দাবি তুলছে। সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের এক সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রনীতি। ঘটনাচক্রে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর বিরূপ আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ক্রমে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পানীয় জলের সঙ্কট অন্য মাত্রা পেয়েছে। তাই শীঘ্রই পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে রাষ্ট্রনীতি অবশ্যম্ভাবী।
চ্যালেঞ্জ ৪: কালো টাকা উদ্ধার ও বেনামী সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এই সরকারের কাছে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সামনের পাঁচ বছরে ঋণ-খেলাপি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের ব্যবস্থা করা এই সরকারের অন্যতম কাজ হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য, নির্বাচনী ইস্তেহারে ও জনসভাতেও কালো টাকা উদ্ধারের বিষয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল এই বিজেপি সরকারের। আশা রাখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ভিতরে ঘটে যাওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলিরও ঠিকমতো তদন্ত হবে।
তাই আগামী পাঁচ জুলাই কেন্দ্রীয় বাজেটের দিকে চোখ থাকবে আমাদের। আমরা নজরে রাখব ঠিক কতগুলি চ্যালেঞ্জের এবং কী পদ্ধতিতে সমাধান করে এই সরকার।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy