এয়ার ইন্ডিয়া বিগত ১৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অর্থক্ষতি বহন করে আসছে। —ফাইল চিত্র।
গোটা দেশ যে ভাবে এয়ার ইন্ডিয়া-র বেসরকারিকরণের বিষয়টিকে স্বাগত জানাতে শুরু করেছে, তাতে মনে হয় এর মধ্যে নির্ঘাত কিছু গোলমাল আছে। এই দেশে আজও অরুণ শৌরীকে সেই সব সংস্থাকে বেসরকারিকরণের জন্য জবাবদিহি করে যেতে হচ্ছে, যেগুলি গুরুত্বের দিক থেকে বিচার করলে এয়ার ইন্ডিয়ার পাশে দাঁড়াতেই পারে না। দেশের একদা বৈগ্রহিক বিমান পরিবহণ সংস্থাটির বিক্রি হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনও রাজনৈতিক পক্ষ থেকে যে তেমন সমালোচনা উঠে আসছে না, এই বিষয়টি কিন্তু লক্ষ করার মতো। মাঝে মাঝে অবশ্য বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং সংস্থার কর্মীদের তরফে কিছু প্রথা-মাফিক স্বর উঠে আসছে, কিন্তু সেই সব উচ্চারণ খুব বেশি বিশ্বস্ত নয়। ‘বিশ্বস্ত’ নয় এই কারণেই যে, সংস্থার বেসরকারিকরণ সম্পন্ন হলে কর্মীদের বেতন প্রাপ্তি যে নিয়মিত থাকবে, এ বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত।
যেটি গোলমালের বিষয় সেটি এই যে, এয়ার ইন্ডিয়া বিগত ১৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অর্থক্ষতি বহন করে আসছে। এমন উদাহরণ সরকারের অন্য অনেক সংস্থারই রয়েছে, কিন্তু তাদের কেউই এয়ার ইন্ডিয়ার সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণের ধারে কাছেও আসতে পারে না। সংস্থাটির সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে অতি বড় বামপন্থীও স্বীকার করবেন যে, এই বিমান পরিবহণ সংস্থাটি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে উত্তরণ অসম্ভবেরই নামান্তর। সংস্থাটির ধস যে অনিবার্য, তা নিশ্চিত। তার উপর রয়েছে বিমানবন্দরগুলিতে পরিসরশূন্যতা, শতাধিক বিমানের জরাজীর্ণ দশা ইত্যাদি সমস্যা। সেই সব সমস্যা সামগ্রিক ভাবে বিমান পরিষেবায় মন্দা নিয়ে আসার আগেই এবং সংস্থার কর্মীদের নগদ-বিদায় প্রদান করার আগেই বা মোদ্দা কথায় গোলযোগ ও প্রবল বিড়ম্বনা ঘটার আগেই সাবধান হওয়া যে সবিশেষ প্রয়োজন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এয়ার ইন্ডিয়া-র বেসরকারিকরণে যে সরকার স্বস্তি বোধ করবে, সে কথা এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যখন সংস্থার হস্তান্তরের দিন টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এক বৈঠক সারেন। এই ঘটনা ছাড়াও, কী ভাবে ৬১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ঋণের বন্দোবস্ত করা হবে, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের আধিকারিকরা মাথা ঘামাতে শুরু করেন। তা থেকেও সরকারের তরফে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সরকারের হাতে থেকে যাওয়া সংস্থার বিমান-বহির্ভূত স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা মূল্যের এবং বিক্রি বাবদ পাওয়া অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (সংস্থার বাকি ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের দায় বহন করতে টাটা গোষ্ঠী রাজি হয়েছে)।
এর পরেও যে ৪৪ হাজার কোটি টাকা বাকি থাকে তা মেটানোর বকলম দায়িত্ব এমন ভাবে পালনের বন্দোবস্ত হয়েছে, যাতে কোনও পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতা, উভয়কেই এই লেনদেনে খুশি রাখার বন্দোবস্ত সাম্প্রতিক ইতিহাসে উদাহরণস্বরূপ হয়ে থাকল।
সুতরাং, এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে টাটা গোষ্ঠীর প্রবেশ সরকারের কাছে যখন স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসছে, তখন সংস্থার বিলয়কালে সম্পূর্ণ নীরব থাকা এক ব্যক্তির তরফ থেকে কোনও বার্তা কেউ আশা করতেই পারেন। তিনি মনমোহন সিংহ সরকারের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী প্রফুল্ল পটেল। প্রফুল্ল পটেলই এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একত্রকরণের কাজটি করেছিলেন, যার ফল দাঁড়ায় ভয়াবহ। কারণ এমন একত্রকরণের থেকে উদ্ভূত সম্মিলিত ধাক্কার কথা আগে থেকে অনুভব করা যায়নি। অতীতে বিপুল পরিমাণে বিমান কেনার জন্য পটেলকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যার ফলে সংস্থাকে যে পরিমাণ ঋণের জালে জড়াতে হতে হয়, তার নজির ইতিহাসে বিরল। এ ছাড়াও এমন কথাও শোনা গিয়েছিল যে, বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলিকে জায়গা ছেড়ে দিতে সরকারি সংস্থাকে বিমান বন্দরের সময় সারণীর গুরুত্বপূর্ণ পরিসরগুলি থেকে সরে আসতে হয়। বিজয় মাল্য তাঁর বিমান পরিবহণ সংস্থা (অধুনালুপ্ত)-কে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। তিনি জনসমক্ষেই মন্ত্রীকে অন্য সংস্থার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের উত্তরে পটেল ক্রুদ্ধ ভাবেই জানান যে, মাল্যর কিংফিশার আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার শর্তপূরণের ধারেকাছেও আসে না।
এয়ার ইন্ডিয়া এখন থেকে টাটা গোষ্ঠীর অলাভজনক সংস্থাগুলির তালিকাভুক্ত হল। এন চন্দ্রশেখরনের নেতৃত্বে সংস্থার পরিচালনার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও টাটা গোষ্ঠী আর্থিক দিক থেকে তার ‘কল্পতরু’ (টাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিসেস বা টিসিএস) ব্যতিরেকে গত তিন বছর ধরেই আয়ের থেকে অধিক ব্যয়ের সঙ্কেত দেখাচ্ছে। এ বছর হয়তো ছবিটি পরিবর্তিত হতে পারে, কারণ টাটা স্টিল ইস্পাতের বর্ধিত মূল্যের পরিস্থিতিকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করে টিসিএস-এর থেকেও বেশি লাভ করতে পারে। যদি এয়ার ইন্ডিয়া কিছুকালের জন্য লোকসানেও চলে, তা হলেও মোট লোকসানের মাত্রা কমবে। সংস্থার তরফে প্রদেয় সুদের মাত্রাও কমবে, বকেয়া ঋণের পরিমাণও হ্রাস পাবে। এবং পাশাপাশি তাদের অন্যান্য বিমান পরিবহণ সংস্থার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে যাত্রীসংখ্যাও বাড়ানো সম্ভব হবে। উপরি হিসেবে টাটারা যে সরকারের মন্ত্রীর কাছে জনসমক্ষে আক্রান্ত হবেন না, সে কথাও নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy