Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
school

School Open: আমাকে ওদের প্রশ্ন, স্যার, স্কুল খুলবে কবে? আমারও প্রশ্ন, স্যার, স্কুল কবে খুলবে?

অভিভাবকদের বলছি, আজ স্কুল বন্ধ আছে ঠিক। তবে খুলবে এক দিন। আপনাদের সন্তানদের ভর্তি করে রাখুন।

মাস্টার হয়েছি, অথচ ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমাদের কাছে। লজ্জা হয়।

মাস্টার হয়েছি, অথচ ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমাদের কাছে। লজ্জা হয়।

নীহারুল ইসলাম
নীহারুল ইসলাম
শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২২ ১৮:১৩
Share: Save:

প্রায় ২৩ মাস সব স্কুল বন্ধ। তবু প্রতি মাসেই দু’দিন বা তিন দিন শিক্ষকদের স্কুলে যেতে হয় মিড-ডে মিলের জিনিসপত্র বিতরণের জন্য। অথবা কন্যাশ্রী-ঐক্যশ্রীর মতো কাজগুলির জন্য। আর গত ডিসেম্বর থেকে তো প্রায় রোজই যেতে হচ্ছে।

যদিও স্কুলে ছাত্রছাত্রী নেই। ক্লাস নেওয়ার দায় নেই। তবু ছেলে-ভোলানো পরীক্ষা আছে। সেই পরীক্ষার ‘নম্বর শিট’ তৈরির কাজ আছে। রিপোর্ট কার্ড তৈরির কাজ আছে। নতুন ক্লাসের খাতায় নাম তোলার কাজ আছে। যারা বেরিয়ে যাচ্ছে তাদের বদলির শংসাপত্র (টিসি) দেওয়ার কাজ তো গুরুদায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে।

আমি নিজেও এক জন শিক্ষক। একটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের ‘শিক্ষা সম্প্রসারক’। এত দিন আমরা ছ’জন ছিলাম। আমাদের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য সম্প্রসারক সবে প্রয়াত হওয়ায় মাননীয় সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক (বিডিও)-এর কথায় সব দায়িত্ব এখন আমাকেই পালন করতে হচ্ছে। অভিজ্ঞতা তাই একেবারে টাটকা।

গত বছর আমাদের এই শিক্ষাকেন্দ্রে (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি) ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১১৬। এ বছর এখন পর্যন্ত ১০২। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে পেরেছি মাত্র ১৩ জনকে। এই সংখ্যা ২০-তে পৌঁছবে কি না সন্দেহ! কেন না, অধিকাংশ অভিভাবকের মুখেই শুনছি, ‘‘ভরতি হুই কী করবে? ইশকুলই তো হয় না! ক’বছর ধইর‍্যা বন্ধ আছে।’’

শুনে অভিভাবকদের বলছি, আজ স্কুল বন্ধ আছে ঠিক। তবে খুলবে এক দিন। আপনাদের সন্তানদের ভর্তি করে রাখুন। যখন স্কুল খুলবে, তখন ওরা স্কুলে যাবে। তা ছাড়া সরকার প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য বিনাপয়সায় বই-খাতা, পোশাকআশাক, সঙ্গে কন্যাশ্রী-ঐক্যশ্রীর টাকাপয়সাও তো দিচ্ছে। তারা পাবে।

অভিভাবকদের কথা, ‘‘তার চেহে বাড়িতে বস্যা বিড়ি বাঁধবে। না হয় রাজমিস্ত্রির কামে যাবে। সরকারের ফ্রি-র চেহে ম্যালা ভাল। ম্যালা বেশি রোজগার।’’

উত্তর দিতে পারি না। উত্তর দেব কী? মাস্টার হয়েছি, অথচ ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমাদের কাছে। লজ্জা হয়।

উত্তর দিতে পারি না। উত্তর দেব কী? মাস্টার হয়েছি, অথচ ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমাদের কাছে। লজ্জা হয়। —নিজস্ব চিত্র।

আজকের দিনে এমন সংলাপ বিনিময় আমার মতো প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকর্মীর নিত্য অভিজ্ঞতা। অভিভাবকদের এ কথার পর আমাদের আর কোনও প্রশ্ন থাকে না। আমরা নিরুপায় হয়ে ফিরে আসি। লোকে বলতেই পারে, বাড়িতে বসে বসে বেতন পাচ্ছে, মাস্টারদের আর চিন্তা কী!

আমি যে পথে স্কুলে যাই, অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে দেখা হয়। তারা ছুটে এসে আমাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘‘স্যার কবে স্কুল খুলবে? আমরা কবে থেকে স্কুলে যাব?’’

উত্তর দিতে পারি না। উত্তর দেব কী? মাস্টার হয়েছি, অথচ ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমাদের কাছে। লজ্জা হয়। ভীষণ লজ্জা! বলতে ইচ্ছে করে, আমরা মাস্টার নয় রে, ‘মাস্টর’ হয়েছি।

আমাদের এখানকার একজন খুব বড় গেরস্ত তাঁর সিংহদরজায় বসে থাকতেন বিকেলবেলা। সামনের রাস্তা দিয়ে পরিচিত কাউকে যেতে দেখলেই ডেকে কথা বলতেন। পাশের গ্রামের এক জন ছিল, যে আবার গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁকে দেখলেই সেই গেরস্ত ডেকে বলতেন, ‘‘কী হে মাস্টর, ওই মাস্টরিই করছিস না চাকরিবাকরি পেলি?’’ মনে পড়ে যায় ছেলেবেলাকার সেই কথা।

মনে পড়ে আরও একটা ঘটনার কথা। ছেলেবেলায় আমাদের স্কুলে যেতে-আসতে দেখে আমাদের এক প্রতিবেশীর সন্তান স্কুল যেতে চেয়েছিল। তার আব্বা তাকে খুব পিটিয়েছিলেন। সেই প্রতিবেশীকে যখন আমার আব্বা জিজ্ঞেস করেন, ছেলেকে এমন করে মারলেন কেন? সেই প্রতিবেশী বলেছিলেন, ‘‘মারব না তো কী করব? তুমার বাপ পণ্ডিতসাহেবের মুতোন ভুঁই (জমি) বিক্রি কর‍্যা ছেল্যাপিলাকে পঢ়াবো নাকি! তুমার বাপের মুতোন পণ্ডিত হামি হতে চাহি না। তুমাধের মুতোন অরা পঢ়ুক হামি চাহি না। অরা হামার জোতে খাটুক। হামার ভুঁই বাঢ়ুক।’’

সেই প্রতিবেশীকেও আমার খুব মনে পড়ে। লোকটার ভুঁই কেনার নেশা ছিল। শুধুই ভুঁই কিনতে চেয়েছিল সে। আমাদের পুরো ডোমকুল-বিলডোমকুল মাঠটাকেই কিনতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কিনতে পারেনি। কেউই পুরো মাঠ কিনতে পারে না। আর যে ছেলেটি সে দিন স্কুলে যেতে চেয়ে তার আব্বার হাতে মার খেয়েছিল, সে পরিবার থেকে ত্যাজ্য হয়েও মাধ্যমিক পাশ করে আজ খুব সৎ ভাবে সংসার-ধর্ম পালন করছে।

শেষ করি একটা ঘটনা দিয়ে। স্কুলের গেটে পৌঁছে দেখি দু’জন ছাত্র দাঁড়িয়ে। এক জনের নাম উকিল শেখ। আর এক জনের নাম সাকিম শেখ। দু’জনেই বর্তমান বছরে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আমাকে দেখেই তারা জিজ্ঞেস করল, ‘‘স্যার, স্কুল কবে খুলবে?’’

আগেই বলেছি, মাস্টার হয়েও আমার কাছে এর কোনও উত্তর নেই। এ আমার শুধু শিক্ষকজীবনের নয়, এক জন অভিভাবকজীবনের লজ্জা। আমি লজ্জিত।

অগত্যা আমিও মাননীয় সরকার বাহাদুরের কাছে জানতে চাইছি, স্যার, স্কুল কবে খুলবে? এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ বার স্কুলগুলো খুলুক!

(লেখক লালগোলার একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষা সম্প্রসারকমতামত নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

school School Open
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy