Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Justice

ফাঁসি হল, কিন্তু ইনসাফ?

নির্ভয়ার মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচ বছরে শুধু দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ২৭৭ শতাংশ (তিন বছরের শিশুও আছে সেই তালিকায়)।

ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০১:২৯
Share: Save:

আদালত ফেরত প্রৌঢ়া মা বাড়িতে এসে মেয়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন সজল চোখে। ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এতদিনে তুই ইনসাফ পেলি।” এই মুহূর্তের জন্যে তাঁঁর সাত বছরের লড়াই, তাঁর হাজার বার ভেঙে পড়া এবং উঠে দাঁড়ানো, কলজের মধ্যে অসহ্য আগুন জ্বালায় তাঁর দগ্ধে যাওয়া শরীর, তাঁর ঝলসে যাওয়া মন। তার পর চার অপরাধীর ফাঁসি হয়ে গেল। কেমন লাগছে এই মায়ের? মিডিয়া, আইনজীবী, আন্দোলনকারী, নারী অধিকার কর্মী সকলেই স্বক্ষেত্রে অবদান রাখলেও শেষমেশ নির্ভয়া ও তাঁর মায়ের জ্বালা, যন্ত্রণা, ইনসাফের শরিক ভারতের সাধারণ মেয়েরা। যাঁরা হেঁসেল সামলান, বাসে ট্রেনে চড়েন, রাস্তার ধুলোয় পা ফেলেন, জীবন সংগ্রামে কাব্যে উপেক্ষিত সৈনিক হয়ে লড়ে যান। কলজের জ্বালা ঠান্ডা হলে তাঁদের মনে এই প্রশ্ন উঠে আসবেই— ইনসাফ কি হল?

নির্ভয়ার মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচ বছরে শুধু দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ২৭৭ শতাংশ (তিন বছরের শিশুও আছে সেই তালিকায়)। হায়দরাবাদের ধর্ষকদের ‘এনকাউন্টার’ হয়ে যাওয়ার পরও ভারতে প্রতি পনেরো মিনিটে এক জন মেয়ে ধর্ষিত হন (প্রত্যহ কমবেশি পঁচানব্বই জন।)। অপরাধীরা ভয় পেল না কেন ‘এনকাউন্টার’ দেখে?

একটি সঙ্গত প্রশ্ন উঠে আসছে। ধর্ষণের অপরাধে প্রাণদণ্ড পাওয়া অপরাধীদের বার বার আসতে দেখা যাচ্ছে সমাজের দরিদ্র শ্রেণি থেকে। দরিদ্র হলে অপরাধের সাজা হবে না, মোটেই তা বলা হচ্ছে না। কিন্তু ধনী বা প্রভাবশালী হলে সব সময় ভয় হয়— বিচার, বিশেষত সুবিচার হয়ে উঠবে তো? এ দেশে প্রতি চার জন ধর্ষকের মাত্র এক জন সাজা পায়; তাও উপযুক্ত সাজা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পায় না।

কামদুনীর খুনিদের কী হল? কাঠুয়া বা উন্নাও কাণ্ডে ক’জনের ফাঁসি হল? সেখানে তো অভিযুক্তের তালিকায় নেতা, মন্ত্রীও রয়েছেন। হায়দরাবাদের পুলিশের উপর ফুল ছোড়ার সময় আমরা ভুলেই গেলাম, তিন তিন বার নির্যাতিতার বাবাকে তাঁরা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সময় মতো এফআইআর নিয়ে সন্ধান শুরু করলে মেয়েটি হয়তো জ্বলে কাবাব হয়ে যেতেন না! আমাদের কাছে কোনটা বড়— মেয়েদের রক্ষা করা, না একটিমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেখে মিষ্টি বিতরণ?

আজ কারা সন্তোষ প্রকাশ করছেন নির্ভয়া বা হায়দরাবাদ কাণ্ডের অপরাধীর মৃত্যুতে? সেই রাজনীতিকরা যখন সুচিন্তিত শব্দের ঝাঁপি নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, তাঁদের বিবেকে বাধে না? এই মুহূর্তে আমাদের সংসদে ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সাংসদের সংখ্যা এ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পাঁচশো তেতাল্লিশ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে দুশো তেত্রিশ জনের নামে ক্রিমিনাল কেস রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস-এর (এডিআর) রিপোর্ট বলছে, ভারতের সংসদের ৪৩ শতাংশ সদস্য খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ইত্যাদি নানা গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত। অভিযোগ মানেই প্রমাণ নয়। কিন্তু আইনপ্রণেতাদের প্রায় অর্ধেক যদি অপরাধে অভিযুক্ত হন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সঠিক আইন প্রণয়ন তা হলে করবেন কারা?

মৃত্যুদণ্ড নৈতিক ভাবে ঠিক কি ভুল, সে সব তর্কে না গিয়ে বলতেই হবে, ভারতের অধিকাংশ মেয়ে এই ফাঁসির অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু শেষ কথা তো দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা? মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ির সিলিং ফ্যান, সর্বত্র যে তাঁদের দেহে মৃত্যুগন্ধ! আইন, সাজা তাকে মুছে দিতে পারছে কই? পুলিশকে অভিযোগ নিতে হবে, ঠিক সময়ে তদন্ত শুরু করতে হবে। অপরাধের অভিযোগ থাকলে সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলিকে। অভিযোগকারীর পরিবার যাতে অর্থনৈতিক এবং আইনগত সুবিধা পায়, তাদের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। প্রতি পনেরো মিনিটে একটি রক্তাক্ত দেহ, একটি বুকচেরা আর্তনাদ— দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের বারোমাস্যা বলে আমরা সে সব কানে নিই না। কাগজে ক’জন নির্ভয়ার কাহিনিই বা উঠে আসে? আমার পাশের বাড়ি, আমার চলার পথের পাশে, আমারই পরিবারে হয়তো মরে বেঁচে গিয়েছে অথবা বেঁচে মরে আছে আরও কত নির্ভয়া?

আইন আদালত, পুলিশ, এ-সবের পরেও প্রশ্ন থেকে যাবে। বুদ্ধি, মেধা, স্বার্থত্যাগ, শ্রমের নিরিখে নয়, নারীকে কেবল হাড়মাংস হিসাবে দেখার অভ্যাস আমাদের বহুকালের। শিক্ষা, ধর্ম, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রায় কোথাও তার স্বতন্ত্র মানবসত্তার স্বীকৃতি শেষ কথা বলে না। তাই সমাজ ধর্ষিতার জামাকাপড়, চালচলন দেখে। পুলিশ অভিযোগকারীকে নোংরা প্রস্তাব দেয়। নেতারা ‘মিটিয়ে নেবার’ প্রস্তাব, প্রলোভন এবং প্রয়োজনে প্রাণঘাতী নিদান দেন। ধর্ষণ নিয়েও রাজনীতি হয়।

দরকার সমাজ বদল। দরকার ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের বিভেদবিরোধী শিক্ষা দেওয়া। তারা যেন কখনও না ভাবে, তারা মেয়েদের ‘রক্ষক’। তা হলে নিজেদের ‘প্রভু’ ভাবতে তাদের সময় লাগবে না। রক্ষকের বড় ভক্ষক নেই। নির্ভয়া কেসে অপরাধী প্রশ্ন তুলেছিল, অত রাতে বন্ধুকে নিয়ে তরুণী রাস্তায় বেরোবে কেন? তাকে এ-প্রশ্ন শিখিয়েছে তার বড় হওয়ার প্রতিটি স্তর। ধর্ষণ শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে পারে ছেলেদের সুশিক্ষা। প্রত্যেক মেয়েকে পুলিশ পাহারায় রাখা যায় না, ক্যারাটেও শেখানো যায় না। ভারতের মা-বাবারা দয়া করে ‘পুরুষ’ নয়, ‘মানুষ’ তৈরি করুন। তারা নারীর বন্ধু হোক, রক্ষক বা ভক্ষক নয়। সেই বন্ধুত্বই হবে নির্ভয়ার জন্য যথার্থ ইনসাফ।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Justice Law Nirbhaya Case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy