মুসলিম মহিলাদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, যা ‘প্রোটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ’ নামে বৈধতা পেয়েছে।
তিন তালাক নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। ৩০ জুলাই সংসদের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভায় যে বিল পাস হয়েছে, তাতে শিলমোহর দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। মুসলিম মহিলাদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, যা ‘প্রোটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ’ নামে বৈধতা পেয়েছে। সংসদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু আইন প্রণয়নের কারণ এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে সেই আইনের ফায়দা হাসিলের জন্য যদি কোনও রাজনৈতিক দল প্রচারে নেমে পড়ে, তা কখনওই অভিপ্রেত নয়।
কোনও একটি বিষয়ে বিতর্ক ভাল। তাতে একটি সামাজিক প্রথার বিবর্তন এবং পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্ভব হয়। দেশের হাতে সেই পরিসর রয়েছে। সংবিধান সংশোধনের সুযোগও রয়েছে মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে। মুসলিম মহিলাদের অধিকার রক্ষার জন্য আলাদা করে কোনও আইন পাশ করানোর প্রয়োজন রয়েছে কি? মুসলিমদের জন্য দেশে কেন ভিন্ন ধরনের আইন তৈরি করতে হবে— এই বিশেষ জায়গাটি বোঝার প্রয়োজন সর্বপ্রথম। এর পিছনে এক ও একমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা রয়েছে। কখনও মুসলিম তোষণ, আবার কখনও মুসলিম দমন এর মূল কারণ বলে মনে হয়। তাই ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার মসনদে বসার পর পরই যে বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তা হল— তিন তালাক প্রসঙ্গ। তিন তালাক কথাটির আভিধানিক এবং ব্যাপক অর্থ কী, তা আমাদের জেনে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তা আমরা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকেই করিনি। আর সেখান থেকে অযাচিত বিতর্কের সৃষ্টি, ভুল বোঝাবুঝি। ইসলাম ধর্মে তিন তালাক বলে যে কথাটি রয়েছে তার সঙ্গে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের আকাশপাতাল ফারাক। মন গড়া কথা না বলে ইসলাম ধর্মে যেটুকু রয়েছে সেটুকু বলতে চাই।
‘‘যদি কোনও স্ত্রী স্বামীর অধিকার আদায় না করে; বরং উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়, তা হলে স্বামীর দায়িত্ব হল তাকে সংশোধনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। তালাক দেওয়ার আগে ইসলামে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। স্বামী সেগুলি অনুসরণ করবে। তার পরেও যদি স্ত্রীর মধ্যে কোনও পরিবর্তন না আসে, তা হলে চূড়ান্ত ফয়সালা তালাক দেওয়ার পথ বেছে নিতে পারবে।
উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যার সঙ্গে সংবিধানের আইনের মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক, সেই তাৎক্ষণিক তিন তালাক ইসলামে জায়েজ আছে—এমনটা কিন্তু নয়। স্বামী এবং স্ত্রীর পরস্পরের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হোক বা সালিশি সভার মাধ্যমে—বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে পারে। তবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সে ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
প্রশ্ন হল ইসলামে যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদের এই প্রক্রিয়া ধারাবাহিক ভাবে নিরবিচ্ছিন্ন পদ্ধতিতে হওয়ার কথা, সেখানে হঠকারী সিদ্ধান্তের বশে কোনও পুরুষ তার স্ত্রীকে বিবাহের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে কখনওই গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রত্যেকটি ধর্মের এক একটি বিধান থাকবে এটা খুব স্বাভাবিক।
ইসলামের বিধান যে রাষ্ট্রকে মেনে চলতে হবে এর কোনও মানে নেই। রাষ্ট্র স্বাধীন এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ। রাষ্ট্রের ক্ষমতা রয়েছে দেশের জনগণকে ঠিক পথে চালিত করার জন্য আইন প্রণয়ন করা এবং তার পুনর্বিবেচনা করার। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের আইন বিভাগ শুধু ইসলাম কেন, কোনও ধর্মকেই অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। তা হলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা যেখানে কোনও অস্তিত্বই নেই, সেখানে আলাদা করে এই বিল পাস করানোর কোনও প্রয়োজন আছে কি? বরং দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ অপুষ্টির কারণে ব্যাধিতে ভুগছে, হাজার হাজার কৃষক ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর বাসস্থানের মতো অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে কোটি কোটি মানুষ। আগে তাদের কথা ভেবে দেখা উচিত ।
বিবাহ বিচ্ছিন্ন মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং তাদের ভরণপোষণের জন্য স্বনির্ভর করার ব্যবস্থা— এগুলি রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। সে সব নিয়ে ভাবলেই বরং কাজের কাজ হত। তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিয়ে এত এত মানুষের মধ্যে রোজ নিচু পর্যায়ের বিতর্ক তৈরি হয়েছে যে, সেখান থেকে ধর্মীয় মেরুকরণের মতো কাজে ঘৃতাহুতি দিয়েছে উভয় পক্ষই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, রাষ্ট্র একটি ধন্দের মধ্যে রাখতে চেয়েছে সাধারণ মানুষকে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক কথাটি তাই সোনার পাথরবাটি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এই কথাও বা অস্বীকার করি কী করে যে, এরকম বহু দম্পতির ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছে এরকম একটি ভুল ব্যাখ্যার কারণেই।
বাস্তব একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। স্বামী-স্ত্রীর প্রচণ্ড মনোমালিন্যের সময়ে স্বামী রাগের বশে তার স্ত্রীকে তিন বার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে। কিছুক্ষণ পরে সেই পুরুষ আফসোস করতে থাকে, কারণ তাকে সমাজ শিখিয়েছে যে কোনও অবস্থাতেই একসঙ্গে তিন বার তালাক বললেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়। কিন্তু এ কোন দেশি আইন! যেখানে স্বামী-স্ত্রীর তীব্র চাওয়াপাওয়া তুচ্ছ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটবেই, যেহেতু স্বামী এক সঙ্গে তিন বার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলেছে! ইসলাম একেই মান্যতা দেয়।
সে ক্ষেত্রে সমাজের যারা একটু শিক্ষিত, মুসলিম-সমাজ যাদের মান্যতা দেয়— সেই মৌলবীদের উচিত ছিল আসল জিনিস বুঝিয়ে দেওয়া। কিন্তু তা না করে তিমিরেই রাখা হয়েছিল মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশকে। আজ যারা তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী বিল পাস হওয়া নিয়ে লাফালাফি করছে, তারা আসলে রাজনৈতিক ফায়দা বুঝতে পারছে না।
অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে বিজেপি এসে এই বিল পাস করাল। এত দিন কারও পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। সম্ভবপর হয়নি— কারণ, এর আগের সরকারও নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানোর জন্য মুসলিমদের ঘাঁটাতে যায়নি। আবার, বিজেপি সরকার এমন ভাবে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে চাইছে যেন, দেশের সমস্ত বিবাহ বিচ্ছিন্ন মহিলাদের কর্মসংস্থানের এবং ভরণপোষণের ভার সরকার একাই গ্রহণ করছে! এমন হলেও না হয় বোঝা যেত, কাজের কাজ কিছু হয়েছে।
সংসদের কিছু সদস্যদের তিন তালাক বিরোধী বিলের প্রতিবাদ করে ভোট দেওয়াটাও এক ধরনের মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়। যাঁরা সাংবিধানিক এই বিলের বিরুদ্ধে মতামত প্রদান করেছেন, তাঁরা যে আরেক ধাপ এগিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বিচরণ করছেন, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই।
আরেকটি বিষয়। সঙ্ঘ পরিবারের অনেকে ইতিমধ্যে প্রচার করতে শুরু করেছে যে, এই বিল বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্য। রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্রের সতীদাহ প্রথা রদ বা বিধবা বিবাহ আইনের মতো এই বিলের প্রবক্তা নাকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
কিন্তু সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, সংবিধানের কোনও বিল পাস করাতে গেলে সংখ্যাধিক্যের ভোট সব সময় অগ্রগণ্য। সুতরাং, মুসলিম মহিলাদের এই বিল পাসের ফলে যদি সামান্য কিছু দুর্দশা ঘোচে, তবে তা সম্পূর্ণই সাংবিধানিক সাফল্য। কোনও রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির কোনও কৃতিত্ব নেই এর পিছনে।
সব শেষে বলা জরুরি, মুসলিমদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষ এই বিলের সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা বরং সচেতন হোক। অকারণে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীদের লাঞ্ছনার থেকে সতর্ক হোক মুসলিম সমাজ।
লেখক ভগবানগোলার চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy