—ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি দেখিয়া একটি দার্শনিক প্রশ্নে ডুবিতে ইচ্ছা করিতেছে। যে সকল ঘটনা সচরাচর আকস্মিক, আপতিক, এমনকি অপ্রত্যাশিত বলিয়া ভ্রম হয়, সেগুলি কি সত্যই আকস্মিক, না কি তাহার মধ্যে এক সূক্ষ্ম কার্যকারণ সূত্র কাজ করিতে থাকে? ওই অলক্ষ্য সূত্রকেই কি স্বল্পদর্শী মানুষ ‘নিয়তি’ বলিয়া কল্পনা করে? দেশের এক সঙ্কটমুহূর্তে, সপ্তদশ জাতীয় নির্বাচনের একেবারে শেষ প্রহরে, কলিকাতা শহরে যে ভাবে হঠাৎ ‘অপ্রত্যাশিত’ পুনরাবির্ভাব ঘটিল এক ক্ষণজন্মা তারকাপুরুষের, তাহা দেখিয়া প্রশ্নটি উঠে। এই পুনরাবির্ভাব কি এক গভীর অর্থ বহন করে না? দেশবাসীকে কিছু বলিয়া দেয় না? ভারতবর্ষ গত পাঁচ বৎসরে অনেক আশ্চর্য অবনমন প্রত্যক্ষ করিয়াছে। তাহার অনেক সঙ্কটমুহূর্তের সহিত অনেক বরেণ্য নাম জড়াইয়া গিয়াছে— স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিংবা মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, জওহরলাল নেহরু, ভীমরাও অম্বেডকর, আরও অনেকে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইঁহারা সকলেই অবমাননাকর বিতর্কবৃত্তে জড়াইয়া পড়িয়াছেন। লক্ষণীয়— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামটি কিন্তু এত দিন উঠে নাই। হয়তো তাই শেষবেলায় বিদ্যাসাগর আসিয়া দাঁড়াইলেন বঙ্গসমাজের একেবারে অভ্যন্তরের মঞ্চটিতে, ঠিক যেখানে তাঁহার যাতায়াত ছিল প্রতি দিনের। বাস্তবিক, এই মহান ব্যক্তির শেষ জীবন কাটিয়াছিল তাঁহার স্বহস্তনির্মিত মেট্রোপলিটান কলেজের দেখভাল করিয়া, যে কলেজের বর্তমান নাম: বিদ্যাসাগর কলেজ। সারা জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি ও অসম্মানের বেদনা যেন স্বার্থহীন অপার দানের রূপ ধরিয়া তাঁহাকে এই কলেজের ছাত্রসমাজের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছিল। ছাত্রদের বাড়ি লইয়া আসিতেন, বই দিতেন, অধ্যাপকদের সাধ্যমতো ফলমূল কাটিয়া খাওয়াইতেন। একেবারে শেষের কয়েক দিন যখন তাঁহার হাঁটাচলাও নিষিদ্ধ হইয়াছে, তখনও ‘টুকটুক করিয়া’ হাঁটিয়া আসিতেন তিনি তাঁহার ‘শেষ সাধের সৃষ্টিটুকু দেখিতে’।
গত সপ্তাহে বিদ্যাসাগর কলেজে যাহা ঘটিয়া গেল, তাহার মধ্যে তাই দোষী পক্ষ খুঁজিয়া চুল ছিঁড়িয়া লাভ নাই। কেননা, সে দিন যে যে উপস্থিত ছিল ওই অঞ্চলে, সকলেই দোষী— এমনকি যাহারা উপস্থিত ছিল না, তাহারাও। কলেজ প্রাঙ্গণে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা লইয়া ইতিমধ্যে বিস্তর নাটক হইয়া গিয়াছে, কে ভাঙিয়াছে না জানিয়াও রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীরা মূর্তি পুনর্নির্মাণের আশীর্বাণীর কুৎসিত প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়াছেন। শিক্ষকরা তাহাতে চিন্তায় পড়িয়াছেন— সব দল যদি নূতন মূর্তি জোগান দেয়, রাখার জায়গা তো অকুলান হইবে! অর্থাৎ ভাঙিবার কাজটিও যেমন স্বার্থান্ধ অসম্মানদর্শন, গড়িবার কাজটিও তেমনই। বিদ্যাসাগরের সাধের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং অন্য সকল শিক্ষাস্থান যে এত দিনে এই স্বার্থান্ধ সঙ্কীর্ণ শিক্ষালোকহীন রাজনীতির গহ্বরে গ্রস্ত হইয়াছে, সেই অপরাধ কোনও একক দলের গুন্ডাবাহিনীর নহে, সে দোষ আমাদের দেশজোড়া সমাজের। দরিদ্র
পণ্ডিত বিদ্যাসাগর আজীবনলব্ধ অর্থের সবটুকু দিয়া বিদ্যালয় ও কলেজ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, কেননা তাঁহার দৃঢ় আশা ছিল, ‘লেখাপড়ার কাজ শেষ করিয়া’ ছাত্র ও ছাত্রীরা ‘শিক্ষিত লোক বলিয়া দেশের মধ্যে পরিচিত’ হইবে, ‘দেশবাসীর প্রচলিত কুসংস্কার হইতে মুক্ত’ হইবে, দেশের জনসাধারণের হিতার্থে কাজ করিবে। এ সব বাক্য শুনিয়া আজকের বঙ্গজনের কী প্রতিক্রিয়া হইবার কথা? তাঁহাদের নেতৃবৃন্দ সম্ভবত— রাজনীতিনিরপেক্ষ ভাবে— বিকট অট্টহাস্য করিবেন, এবং পাল্টা জিজ্ঞাসা করিবেন, ছাত্ররা এই সব করিলে দলের ঝান্ডা উড়াইয়া গুন্ডাগিরি করিবার লোক পাইব কোথায়?
নবীন পণ্ডিত মহাশয় চমৎকার সংস্কৃত পড়াইতেন, মেট্রোপলিটান তথা বিদ্যাসাগর কলেজে। এক দিন ছেলেরা তাঁহার ক্লাসে গন্ডগোল করিতেছিল। বিদ্যাসাগর পাশ দিয়া যাইতেছিলেন, বলিলেন, ‘‘কেবল ভাল পড়াইলেই হয় না, ছেলেদেরও ভাল করিয়া দেখিতে হয়।’’ বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থের এই বিবরণ যেন ধাক্কা দিয়া যায়। ‘ভাল করিয়া দেখা’? দ্বিশতবর্ষ পরে ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা’ হয়তো অকারণে পুনরাবির্ভূত হন নাই। হয়তো তিনি বঙ্গসমাজকে বলিতেছেন, ভাবিয়া দেখুন, সন্তানদের ‘ভাল করিয়া দেখিয়াছেন’ তো? সুস্থ, সুষ্ঠু, সংস্কারমুক্ত সমাজের মানুষ করিয়া তুলিয়াছেন তো? এই সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর যদি না পান, তাহা হইলে, থাক, মূর্তি ভাঙা লইয়া কপালে অধিক করাঘাত করিবেন না। লাভ নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy