বুধবার, ২০ মে বিকেলে যে প্রবল ঘূর্ণিঝড় কলকাতা ও বাংলার উপর দিয়ে বয়ে গেল, তার চেয়ে তীব্র, নির্দয় কোনও অভিঘাত গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে বাংলা দেখেনি। সম্মিলিত স্মৃতি তা-ই বলছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, পানীয় জল সরবরাহ ও ইন্টারনেট বন্ধ। জনজীবন স্তব্ধ। মোবাইল টাওয়ার অচল। অজস্র সেতু, দীর্ঘ নদীবাঁধ ভেঙে সংযোগবিচ্ছিন্ন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বড় গাছ পড়ে শহরের রাস্তা বন্ধ। প্রাথমিক সংবাদে ৮০টি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, জীবনহানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা। সাত-আটটি জেলায় তাণ্ডব চলেছে, চার-পাঁচটি জেলা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। ক্ষয়ক্ষতির পুরো হিসেব পেতে আরও সময় লাগবে।
এর সঙ্গে অতীতের কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তুলনা চলবে না। এমনিতেই অর্থনৈতিক মন্দা চলেছে গত এক বছর ধরেই। ২০১৯-এর অগস্টে কর্মহীনতার হার বেড়ে আট শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, উৎপাদন ও নির্মাণ শিল্পে বৃদ্ধি কমে যাওয়ার ফলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন ৫ শতাংশে ঠেকেছিল। লকডাউনের পর অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা পুরোপুরি কাজ হারিয়েছেন। ছোট কারখানা, দোকান-বাজার বন্ধ থাকায় মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষই বেকার। ঘরভাড়া দিতে না পেরে ভিন রাজ্যের শ্রমিক পথে। বহিরাগত হিসেবে রেশন না পেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ অবিশ্রান্ত হাঁটছেন ঘরের দিকে, সংক্রমণের ভীতি ও নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচতে। ঘূর্ণিঝড় যখন মাটিতে নামতে উদ্যত, তখনও বাংলায় শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার ট্রেন মধ্যপথে।
কয়েক লক্ষ মানুষকে কোয়রান্টিন শর্ত-সহ রাজ্যে নিয়ে আসা, করোনা মোকাবিলার নানা ব্যবস্থা; টেস্টিং, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ; গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা; লকডাউনে কর্মহীনদের খাওয়া ও রেশনের ব্যবস্থা— সব কিছুর উপরেও যখন আমপান ঘূর্ণিঝড়ের উদ্যত বজ্র এই বাংলায় নেমে এল, তখন বুকের ভিতর থেকে হাহাকার ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেনি, এমন কোনও বঙ্গবাসী ছিলেন না। দেশের অন্য প্রান্তে, বিদেশে মানুষকে কাঁদতে শুনেছি ফোনে। দুঃখ বেদনা যদি কয়েক লহমার জন্য পাশেও সরিয়ে রাখি, এমন বহুমাত্রিক প্রশাসনিক দায়িত্ব বাংলার সরকারের উপর অতীতে কখনও ন্যস্ত হয়নি।
কোথায় ক্ষতি হয়নি আমাদের! এক দশক আগে আয়লার প্রকোপে বিপর্যস্ত হয়েছিল বাংলা। কিন্তু একই সঙ্গে কলকাতা শহরের হাজার হাজার বড় গাছের উপড়ে পড়া, তার ফলে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে বিদ্যুৎ বন্ধ ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এত মানুষের মৃত্যু অদৃষ্টপূর্ব! ভেঙে পড়েছে কয়েক হাজার সিগন্যাল পোস্ট। লকডাউনে ঘরে বসে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা কাজ করছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন পড়াশোনা করছিল। সব অনিশ্চিত হয়ে গেল। তার চেয়েও বড় সমস্যা পানীয় জল শোধনের, পাম্পে জল তোলার এবং হাসপাতাল পরিষেবার। মৃত্যু ও জলবাহী রোগের সম্ভাবনা বাড়ল। অধিকাংশ মোবাইল অচল। টাওয়ারগুলিতে ব্যাক-আপ পাওয়ার ছিল না। লকডাউন ও করোনার যুগ্ম মোকাবিলায় আমাদের প্রশাসন ও পুরসভাগুলি গত দু’মাস ধরেই পরিশ্রান্ত ছিল, তাদের উপর এ বার এল পরিষেবা চালু ও ত্রাণের দায়িত্ব। উপড়ানো গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে বিদ্যুৎ চালু করতে সময় লাগবে। তত দিন চলবে জলসঙ্কট, এই গ্রীষ্মে!
আয়লার আঘাতে সুন্দরবনের দুশো কিলোমিটারের মতো নদীবাঁধ ভেঙে ডুবিয়ে দিয়েছিল চাষের খেত, নষ্ট হয়েছিল ঘরবাড়ি। দীর্ঘ দিন পানীয় জলের অভাবে তৃষ্ণার্ত ছিল মানুষ। সুন্দরবনে এ বারও বিপুল ক্ষতি হয়েছে। বহু জায়গায় ভেঙেছে পুরনো বাঁধ। ভাঙা ও ফাটলের পথে জল ঢুকে এসেছে। এখনই খবর পেলাম হিঙ্গলগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অমাবস্যার জোয়ারের জল ঢুকছে হু হু করে। দ্রুত মেরামত না হলে কোটালের বানের জলও ঢুকতে থাকবে গ্রামে। ২৮ কিলোমিটার বাঁধ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। পুরনো বাঁধগুলির মেরামতির কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু গভীর ভিতের ‘হাতিবাঁধ’, যার ১৮৪ কিলোমিটার নির্মাণের কাজ আয়লার পর আরম্ভ হয়েছিল, তার বিশেষ ক্ষতি হয়নি। জলোচ্ছ্বাসের সময় ভাটা ছিল বলে বেঁচে গেছে সুন্দরবন। এর ভিতের জন্য চাষিরা জমি দিয়েছিলেন। তবু বড় ক্ষতি হল আগামী চাষের, কারণ লবণজল ঢুকে আসায় মাটি আর কৃষি উপযোগী থাকল না। আয়লার পর উৎপন্ন ধানেও রোগ লেগেছিল। তখন তুষার কাঞ্জিলাল, সুন্দরবনের আদি ও অকৃত্রিম মাস্টারমশাই আমাদের মধ্যে ছিলেন। কৃষি ও পরিবেশের উপর আয়লার প্রভাব নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একটি বই। আয়লার পর ক্ষুধাপীড়িত সুন্দরবন থেকে বহির্গমন বেড়েছিল মানুষের, বিশেষ করে তরুণী মেয়েদের। তাদের যাওয়া ছিল অনেক ক্ষেত্রে কেবল হারিয়ে যাওয়া। আর না ফেরা। এ বার কি আমরা তা ঠেকাতে পারব?
সব জেলাতেই চাষের অল্পবিস্তর ক্ষতি হয়েছে। বোরো ধান গড়পড়তা ৫০ ভাগ কাটা হয়ে গিয়েছিল। বাকি নষ্ট হয়েছে। পানের বরজ, ফুল-ফলের বাগানে ঝড় বৃষ্টিতে নষ্ট হল দাঁড়ানো ফসল। চাষি তো দেশের কোথাও বিমার টাকা পান না। এ বার কি পাবেন? আর, পরের বারের ফসলের জন্য কৃষিঋণ? শহরে ও গ্রামে প্রচুর বাড়ি ও দোকানঘর নষ্ট হয়েছে। গরিবের ঘরের টালি ভেঙে জল ঢুকেছে, উড়ে গেছে টিনের চাল। সেগুলি বর্ষার আগে সারাতে হবে। কিন্তু ঘরে রাখা জিনিসপত্র, ব্যবসার পুঁজি নষ্ট হল। তার পরিমাণ বিপুল। লকডাউনে দোকান বন্ধ ছিল, এখন ভাঙা দোকান না সারালে খোলা যাবে না। শোনা যাচ্ছে, রেশনের জন্য রাখা কয়েক লক্ষ টন খাদ্যশস্য ভিজে নষ্ট হয়েছে। যে দিকে তাকাই, সমস্যার সমুদ্র। এই সব ক্ষতির খতিয়ান অবিলম্বে নেওয়ার জন্য বহু সংখ্যক কর্মীকে নামাতে হবে। অথচ সংক্রমণের ভয়ে মেলামেশা বিঘ্নিত। কোথায় যাবে মানুষ? সামনে দাঁড়িয়ে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থাও তো জরুরি।
বিপর্যয়ের পূর্বাভাস সময়ে পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগর ও সন্নিহিত অঞ্চলে মে ও নভেম্বর মাসের ঘূর্ণিঝড় এখন প্রত্যাশিত দুর্যোগ। গত কুড়ি বছর ধরে ওড়িশায় বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনা প্রশাসনিক কাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাতেও এ বার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে বহু লক্ষ জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এটা কম কথা নয়। এর পর ত্রাণ হবে, পুনর্বাসনও। পরিকাঠামো মেরামত হবে। কিন্তু এই ত্রিমাত্রিক আঘাত বাংলার অর্থনীতিকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে কয়েক বছর।
সবচেয়ে চিন্তার কথা, বাংলার অর্থনীতি আর কত চাপ নিতে পারে? অর্থ কোথায়? করোনা মোকাবিলার জন্য আর্থিক প্যাকেজ পাওয়া যায়নি, আমরা জিএসটি সংগ্রহ পরিপূরণের টাকাও পাইনি। এফআরবিএম আইনে আর্থিক ঘাটতির মাত্রা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার অনুমতিও পাওয়া যায়নি। সহানুভূতির চেয়েও এখন বড় দরকার অর্থ। অর্থের প্রয়োজন বাড়বেই, যদি বিপর্যয় মোকাবিলাকে আমাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। কলকাতা পৌর নিগমকে বাদ দিলে অন্য পুরসভাগুলির কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই। ব্যাটারি-চালিত করাত দিয়ে দ্রুত ভাঙা গাছের ডাল কাটা, যান্ত্রিক উপায়ে উপড়ে পড়া বিদ্যুতের খুঁটি সোজা করে সারানো, এগুলো না করলে দ্রুত বিদ্যুৎ চালু করা যাবে না। ১৯৯৯-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ভুবনেশ্বর রাতারাতি খালি হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কিত কর্মীরা নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু যন্ত্র-সহ বিশাল কর্মী-দল পাঠিয়ে বিদ্যুৎ চালু করতে সাহায্য করেন। সে দু’দশক আগেকার কথা। কলকাতায় দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে আকাশরেখাকে তারমুক্ত করতে গেলেও অর্থ দরকার। মাটির নীচ দিয়ে চ্যানেল বাহিত তার। মোবাইল টাওয়ারের ব্যাক-আপ পাওয়ারের জন্য আলাদা ফিডার লাইন। এ সবই বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য জনস্বার্থে জরুরি।
বাংলার গ্রাম ও শহরেও এখনও এত মাটির বাড়ি, সেটা আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার। ‘সবার জন্য গৃহ’ প্রকল্পে কি এখনও অধিকাংশ দরিদ্র ঘর পাননি? মাটির ঘর বিপজ্জনক। শহরে অনেক বস্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ বার। এগুলি অস্থায়ী নির্মাণ, অথচ তাদের ভাড়া অনিয়ন্ত্রিত। টাকা যায় কালোবাজারে। পুরসভা ও বেসরকারি উদ্যোগের মিশেলে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ভাড়া ঘরের প্রয়োজনের কথা বলেছিলাম। ঘূর্ণিঝড় সে কথা আবার মনে করিয়ে দিল। শেষে বলি, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সর্বভারতীয় নিউজ় চ্যানেলগুলি বাংলায় আমপানের ধ্বংসের সংবাদ যে নিস্পৃহ কার্পণ্যে পরিবেশন করেছে, তাতে পীড়িত বোধ করেছি। জনমানস থেকে বিপর্যয়ের ছবি মোছার চেষ্টা ছিল কি তার মধ্যে? বাংলা তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ নিরপেক্ষ ভাবে, দ্রুত করে নিক। কিন্তু সংক্রমণ-জর্জর রাজ্যে, লকডাউনের কর্মহীনতার ভিতর, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মৃত্যু ও ধ্বংসবাহী ঘূর্ণিঝড়কে ‘অতি গুরুতর বিপর্যয়’ ঘোষণা করা হোক। জাতীয় বিপর্যয় ফান্ড থেকে পূর্ণ ও পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় সহায়তা অনুমোদিত হোক বাংলার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy