১৮৬১ সাল থেকেই ব্রিটিশ প্রণীত আইনের ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, ভারতে সমকাম ছিল একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। এমনকি, স্বাধীন ভারতেও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বলবত ছিল এবং সমকামকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হত, যার সর্বোচ্চ সাজা দশ বছর অবধি কারাবাস। তাই আবহমানকাল ধরে সমাজজীবনের আনাচকানাচে সমকাম জড়িয়ে থাকলেও তা থমকে ছিল গোপনীয়তার অন্ধকারাচ্ছন্ন কুঠুরিতেই। যদিও আমাদের সমকামী সহনাগরিকেরা তাঁদের অধিকারের মান্যতার দাবি নিয়ে প্রকাশ্যেই সরব হয়ে এসেছেন। এমনকি, তাঁরা তাঁদের সমকামী প্রবৃত্তিকে আইনি মান্যতা দেওয়ার দাবি নিয়ে বারবার আদালতের দ্বারস্থও হয়েছেন। ২০০৯ সালে দিল্লির মহামান্য উচ্চ আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করাকে সংবিধান প্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল বলে এক যুগান্তকারী রায় দেয়। পরবর্তী কালে কিছু ধর্মীয় সংগঠন দিল্লির উচ্চ আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করে। ২০১৩ সালে মহামান্য শীর্ষ আদালত দিল্লির উচ্চ আদালতের ওই রায়কে খণ্ডন করে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেই পুনর্বহাল করে। শীর্ষ আদালতের এই রায় তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল গণ্য করে বিভিন্ন সমকামী সংগঠন তা পুনর্বিবেচনার জন্যে শীর্ষ আদালতের কাছে পুনরায় আবেদন করেন। ২০১৮ সালে মহামান্য শীর্ষ আদালত তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলীর কাছে পাঠায়।
অবশেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর, দেশের মহামান্য শীর্ষ আদালতের ৪৯৫ পাতার রায়ে সমকামী সহনাগরিকদের সমকামের আইনসিদ্ধ অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। শীর্ষ আদালত তার রায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা থেকে সমকামের অপরাধকে মুক্ত করে। শুধু তাই নয়, শীর্ষ আদালতের রায় অনুযায়ী সমকামিতা কোনও মানসিক ব্যাধি নয়; এমনকি, সমকাম ‘অপ্রাকৃতিক’ অপরাধ নয়। এই রায়ে মহামান্য শীর্ষ আদালত মনে করে যে, “এলজিবিটি-র (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) কাছে ইতিহাস ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে থাকবে।” এবং ‘‘ব্যক্তিগত পরিসরে সহমতের ভিত্তিতে সমলিঙ্গের যৌনসম্পর্ক ক্ষতিকর নয় এবং সামাজিক ভাবে সংক্রামকও নয়।’’
অবশেষে ১৫৭ বছর পরে হলেও সমকামের অধিকার আইনের শৃঙ্খল থেকে না হয় মুক্তি পেল, কিন্তু সামাজিক বা ধর্মীয় অনুশাসন থেকে কি মুক্ত করা গেল সমকামের অধিকারের এই আইনি মান্যতাকে?
জীবনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি পথ চলতে গিয়ে ভারতীয় সমাজকে, বিশেষত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজকে, যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয় না ভারতীয় তথা মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ এত সহজে এত দিন ধরে গড়ে ওঠা রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে শুধুমাত্র আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাতারাতি এই বিষয়ে মুক্তমনা হয়ে উঠবে। সমকাম সম্বন্ধে যে ছুঁতমার্গ আমাদের সামাজিক কাঠামোর অস্থিমজ্জায় মিশে রয়েছে, তা প্রতিস্থাপন করার জন্য এক দিকে যেমন প্রয়োজন খোলামেলা আলোচনার বিস্তীর্ণ পরিসর, অন্য দিকে ভরসা রেখে যেতে হবে সময়ের স্রোতের অমোঘ প্রবাহের উপরেও। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও তো অনস্বীকার্য যে, আমরা যে কাঠামোয় জীবনধারণ করে থাকি, সেখানে সামাজিক অনুশাসন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে, সামাজিক বোধগুলো এখনও প্রায় সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, যা ছিল বিশ্বায়নের প্রাক্কালে।
মহামান্য শীর্ষ আদালতের রায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা থেকে সমকামের অপরাধকে মুক্ত করার পরেও ধর্মের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা এখনও বলে বেড়াচ্ছেন যে, সমকামিতা নাকি একটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ ক্রিয়াকলাপ। তা হলে ওই ভ্রান্ত যুক্তির বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠে প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমরা কি প্রতিনিয়তই যাই না? বিজ্ঞানের সৃষ্টিই তো প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার তাগিদে। গরমকালে দুর্বিষহ গরমই তো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থা। কিন্তু আমরা আমাদের সুবিধার্থে ফ্যান বা এসি ব্যবহার করে কি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করি না! কিংবা, ভ্রূণহত্যা? সে-ও তো প্রকৃতিরই বিরুদ্ধাচারণ। কিন্তু আমাদের সুবিধার্থে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েও তা কি আমরা করে থাকি না! এমনকি মায়ের পেট চিরে সন্তান প্রসবের অস্ত্রোপচার, সেটাও কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়! তা হলে, বিষয়টা কিন্তু আসলে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ নয়। বিষয়টা হল, প্রকৃতির কোনও ক্ষতি না করে বা ন্যূনতম ক্ষতি করে সেই কাজটা মানবজাতির সুবিধার্থে ব্যবহার্য কি না। সমকামে প্রকৃতির কোনও ক্ষতিসাধন হয় বলে আমার অন্তত জানা নেই। তাই চিরাচরিত যৌনপ্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যদি কেউ সমকামে পরিতৃপ্ত হন, তা হলে বাকি সমাজের মাথাব্যথার যুক্তিযুক্ত কারণটা একেবারেই বোধগম্য হয় না! তা ছাড়া, সমকামী প্রবৃত্তির মানুষজনের শারীরবৃত্তীয় প্রকৃতিই সমকামিতায় আসক্তি— সেটাই তাঁদের প্রকৃতি। ফলে, সমকামী প্রবৃত্তির মানুষের কাছে সমকামিতা তাঁদের শারীরিক ও মানসিক গঠনগত প্রকৃতিবিরুদ্ধ কিন্তু একেবারেই নয়।
এই প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত এক বাস্তব অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হল। মহিলা সমকামীদের (লেসবিয়ান) নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রকল্পের কাজে আমার এক বন্ধু নমুনা সমীক্ষার সহযোগী হিসেবে আমায় সঙ্গে নেন। সমীক্ষার কাজের কথোপকথন চলাকালীন এক মধ্যবয়স্ক সমকামী মহিলা আমাদের একটি অকাট্য মৌলিক প্রশ্ন করে বসেন। উনি জানতে চান, “আপনারা, অর্থাৎ বিষমকামীরা, সন্তান সৃষ্টির তাগিদে জীবনে কতবার যৌনমিলনে লিপ্ত হন? একবার অথবা মেরে কেটে দু’বার। কিন্তু বাকি জীবনভর বিষমকামীরা যতবার যৌনমিলনে লিপ্ত হন, তা তো নিছক মানসিক ও শারীরিক পরিতৃপ্তির জন্যেই। তা হলে, আমরা যদি সমকামী যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হই, আমাদের মানসিক ও শারীরিক পরিতৃপ্তির জন্য, তা হলে বাকি সমাজের এত গেল-গেল রব কেন? এই ভাবে নিজেদের যৌনচাহিদা পরিতৃপ্ত করা আমাদের শারীরিক ও মানসিক গঠনগত প্রকৃতি। তাই আমরা যদি এই ভাবে নিজেদের যৌনতৃপ্তি খুঁজি, তা হলে তো অন্য কারও কোনও ক্ষতি হয় না। তবু আমরা কেন এ সমাজে অপাঙ্ক্তেয় হয়েই রয়ে যাব?” আমরা কেউ-ই এই অকাট্য যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা কোনও যুক্তি সে দিন খুঁজে পাইনি।
আজও পাই না।
এখন শুধু ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষার সময়। সমকাম আমাদের সমাজজীবনের অন্তর্গত একটি বিকল্প যৌনক্রিয়া পদ্ধতি মাত্র। সংখ্যালঘু কিছু মানুষজন যা প্রয়োগ করে তৃপ্তি পেয়ে থাকেন। এবং সমকামীরা আমাদের মতোই এই সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য মানুষজন। ধর্মীয় দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের রক্তচক্ষু অতিক্রম করে এই ভাবনা সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে যাওয়ার জন্য হয়তো আরও কিছুকাল অপেক্ষা করে যেতে হবে। দীর্ঘ ১৫৭টা বছর লেগে গেল, মানুষের আর একটি মৌলিক অধিকারের আইনি মান্যতা পাওয়ার জন্য। এর পরেও হয়তো দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হবে সমাজজীবনে সমকামের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করায়। এর জন্য চাই খোলামেলা আলোচনার পরিসর এবং
মুক্তমনা বিবেক। ততদিন মুক্তমনা ভারতাত্মা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে এই মহামানবের দেশের সকল ‘মানব চৈতন্যের’ পানে।
শিক্ষক, বেলডাঙা এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy