১১ সেপ্টেম্বর বললেই প্রাথমিক ভাবে অনেকেরই মনে পড়ে যায় ২০০১ সালের আমেরিকায় সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার কথা। তবে ১২৬ বছর আগে এই দিনেই আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্মসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের ‘শিকাগো বক্তৃতা’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সেই বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের পরমপ্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মের কথা তুলে ধরতে গিয়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার নতুন বার্তা তুলে ধরেছিলেন। বর্তমানে ভারতের কোনও কোনও রাজনৈতিক দল যে ভাবে তথাকথিত হিন্দু ধর্মের স্বরূপ তুলে ধরে অসহিষ্ণু মনোভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে তার সঙ্গে বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার কোনও মিল খুঁজে পাওয়া ভার। আজ থেকে ১২৬ বছর আগে এক জন বাঙালি সন্ন্যাসীর কথা সকলেই সে দিন সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। সমগ্র আমেরিকায় তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল এক নতুন উন্মাদনা। অথচ আজ আমরা বিবেকানন্দের সেই বার্তাকে ভুলে গিয়ে ধর্মীয় হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছি প্রায়ই।
সে দিন তাঁর সেই বাণী প্রচারের জন্য ছিল না কোনও ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামের মতো কোনও মাধ্যম। তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মুদ্রিত সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করে তাঁর সেই বার্তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমেরিকা তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন সমাজ-মাধ্যমে যখন ধর্মীয় উস্কানিমূলক পোস্ট, ছবি বা ভিডিয়ো দেখি, তখন মনে হয় এই ধর্মীয় হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বাতাবরণে বিবেকানন্দের সেই সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার বাণী আজও কতটা প্রাসঙ্গিক।
যদিও তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ থেকে সমুদ্রপথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় ওই সম্মেলনে যোগদান করা এত সহজ ছিল না। উত্তর-পূর্ব রাজস্থানে খেতড়ির রাজা অজিত সিংহ বিবেকানন্দকে শিকাগো যাওয়ার জন্য ‘ওরিয়েন্ট’ জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনে দেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল দারুণ দুঃখ-কষ্ট। গ্রাসাচ্ছাদনের পাশাপাশি ছিল বর্ণ-বিদ্বেষের সমস্যা। সেই সময় পাশ্চাত্যের লোকেদের কাছে এই ভারত ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া এবং কিছু জাদুকর ও সাপুড়েদের দেশ। ধর্ম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মতো কোনও পরিচয় বা সুপারিশ তাঁর কাছে ছিল না।
শেষ পর্যন্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের ব্যক্তিগত পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওই সম্মেলনে মাত্র তিন মিনিট বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বক্তৃতার শুরুতে ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা’ সম্বোধনে প্রাথমিক পর্বেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। এই সম্বোধন শুনে সভায় উপস্থিত প্রায় সাত হাজার দেশ-বিদেশের দর্শক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় দু’মিনিট হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানিয়েছিলেন।
বিশ্বের অন্য ধর্মগুরুরা নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছিলেন। বিবেকানন্দ ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্মের সহনশীলতার বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় এই প্রাচীন ধর্মের সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার জন্য গর্ব অনুভব করার কথা দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ এই ধর্ম শুধু অন্য ধর্মমতকে মেনে নেয় তাই-ই নয়, অন্য ধর্মমতের ভাল দিকগুলি সহজে গ্রহণ করতে পারে। সুপ্রাচীন কাল থেকে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের আশ্রয় দিয়ে এই ধর্ম তার শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের পাশাপাশি এ-ও বলেন যে, বিভিন্ন নদী যেমন নানা পথ ঘুরে শেষে সেই সমুদ্রেই পতিত হয়, তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাচরণ করেও সেই একই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছয়। সমুদ্র নদীকে কখনও বলে না যে, তুমি অমুক পথ দিয়ে এসেছ তাই তোমার জল আমি নেব না। তেমনই ঈশ্বরও কখনও বলেন না যে, তুমি অমুক ধর্মাবলম্বী তাই তুমি আমার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত। সুতরাং ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মীয় উন্মত্ততা, ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই একেবারেই নিরর্থক।
আজ থেকে ১২৬ বছর আগে সুদূর পাশ্চাত্যে তিনি যে ধর্মীয় বার্তা প্রচার করেছিলেন, তার বিপরীত চিত্র আজকের ভারতে আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গো-রক্ষার নামে যে ভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা চলছে তাতে মনে হয়, বিবেকানন্দ অন্য এক হিন্দু ধর্মের কথা সে দিন প্রচার করেছিলেন।
যাইহোক, বিবেকানন্দের সেই বিশ্বজোড়া সাফল্যের কথা শোনার জন্য সে দিন শ্রীরামকৃষ্ণ বেঁচে ছিলেন না। তবু তিনি বিদেশ থেকে ফিরে তাঁর সেই গুরুর আদর্শে ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সেবামূলক আদর্শের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সারা বিশ্বে সেই একই পথ অনুসরণ করে চলেছে। স্বদেশে ফেরার পরে তিনি খুব বেশি দিন বাঁচেননি। ১৯০২ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
গোপালকৃষ্ণ গোখলে, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কঠিন পরিস্থিতিতে বিবেকানন্দ দেশনায়কদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তবে স্বাধীন ভারতের অসহিষ্ণু নাগরিক সমাজ কেন তাঁকে পাথেয় করে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে না?
শিক্ষক, কান্দি রাজা
বীরেন্দ্রচন্দ্র কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy