গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত মানুষের রোগভোগ ও অনেকের অকালমৃত্যু এক দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক চাপানউতোর ও সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। কেন ডেঙ্গি দমন এত দুরূহ হয়ে উঠল?
ডেঙ্গি ভাইরাস থেকে মূলত দু’ধরনের সংক্রমণ হয়— সাধারণ ডেঙ্গি জ্বর ও মরণাত্মক ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গি সিনড্রোম শক। যদিও চটজলদি রোগনির্ণয় এবং হাসপাতালে আপৎকালীন শুশ্রূষার মাধ্যমে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো যাচ্ছে, তবুও মৃত্যু ঘটছে। কারণ আজ পর্যন্ত এই ধরনের জ্বরের সঠিক চিকিৎসা বেরোয়নি। ইতিহাস বলছে, ভারতে ১৭৮০ সালে প্রথম ডেঙ্গি রোগের লক্ষণ নথিভুক্ত হয় তৎকালীন মাদ্রাজে। আর, দেশে প্রথম ডেঙ্গি মহামারি হয় কলকাতায়— ১৯৬৩ সালে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড বা ফিলিপিন্সের মতো ১৯৭০ বা ১৯৮০-র দশক থেকে না হলেও, ডেঙ্গির প্রকোপ ১৯৯০-এর মাঝামাঝি থেকে ভারতের বড় শহরগুলোতে বেড়েই চলেছে। ক্রমে ছড়িয়েছে শহরতলি, গাঁ-গঞ্জ, মফস্সলে। পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গির প্রকোপ ২০০৫ থেকে বাড়ছে এবং এই দশকের শুরু থেকেই এক বাৎসরিক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
মানবদেহে ডেঙ্গির সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এপিডেমিয়োলজির তত্ত্ব বলছে, অনুকূল পরিবেশে (ঠিক বর্ষা পরবর্তী সময়ে) এই রোগের ভাইরাস মশা-দ্বারা মানবদেহে বসতি বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটায়। যে হেতু ডেঙ্গি রোগের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি বা প্রতিষেধক টিকা এখনও সে ভাবে আবিষ্কার হয়নি, তাই মশা-নিধন যজ্ঞ বিনা আর উপায় নেই। আর ঠিক এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণ মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না, বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। ডেঙ্গিকে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, যার ব্যাপ্তি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বহু গুণ বেশি। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গির অন্যতম কারণ হল অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশা-নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং অবশ্যই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ার তুলনায় এর গুরুত্ব কম নয়।
সরকার মশা মারতে সচেষ্ট, সেটা ঠিক। কিন্তু, মশানিধন যদি ঠিক ভাবেই হয়, তা হলে ডেঙ্গির রমরমা বজায় থাকছে কী করে? এ ক্ষেত্রে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের বা কলকাতা বা অন্যান্য পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীদের মশানিধনে অদক্ষতা নয়, বরং অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী। নগরায়ণের নীতি ও রূপরেখায় এবং নগর পরিচালনায় জনস্বাস্থ্যের দিকটি পশ্চিমবঙ্গ-সহ সমগ্র দেশেই অত্যন্ত অবহেলিত। যে কোনও মশাবাহিত রোগের উৎপত্তি সাধারণত শহরকেন্দ্রিক, কারণ শহরের জনবহুল, ঘিঞ্জি, অপরিষ্কার পরিবেশ মশা জন্মানো এবং দ্রুত রোগ সংক্রমণের জন্য আদর্শ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মশা জন্মানোর সঙ্গে পুর-পরিষেবা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। শহরের বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কি না, বর্জ্যের পরিবহণ ব্যবস্থা কেমন; সব সময় নলবাহিত জল পাওয়া যায়, না কি রান্না ও পানের জন্য জল ধরে রাখতে হয়, যে জমা জলে মশা জন্মায়; নির্মাণকাজগুলো বর্ষার সময় অসমাপ্ত না রেখে সময় মতো শেষ করা হয় কি না; জলাশয়গুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কি না; খাল-বিল-নর্দমা নিয়মিত সংস্কার হয় কি না— পুর-পরিষেবা সংক্রান্ত এই প্রশ্নগুলো মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই বিষয়গুলো মশা জন্মানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
এই পুর-পরিষেবাগুলির একটিও পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের অধীনে পড়ে না। যেমন ধরা যাক কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের আওতায় পড়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডের তালাবন্ধ বিপজ্জনক বাড়ি। সেই বাড়িগুলোর ভিতরে যত্রতত্র জল জমা ও আগাছা থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু, বাড়িগুলি বন্ধ থাকার দরুন তার ভেতরে স্বাস্থ্যকর্মীরা ঢুকতেই পারেন না। মশানিধন তো দূর অস্ত্। স্বাস্থ্য বিভাগ মশানিধনের জন্য যত কর্মীই রাখুক, পুরসভার বাকি বিভাগগুলির পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। এই আন্তঃবিভাগীয় পারস্পরিক সহযোগিতাই হল জনস্বাস্থ্যর প্রাথমিক শর্ত, যা পুরসভায় লাইসেন্স থেকে জঞ্জাল, নিকাশি থেকে উদ্যান, জল বণ্টন থেকে বস্তি উন্নয়ন সব বিভাগকেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রাখে। ডেঙ্গি রোধেও তাই জনস্বাস্থ্য-মুখী নগর পরিকল্পনা ও পরিচালনা পদ্ধতি থাকা চাই।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। এখন তা চিকিৎসাকেন্দ্রিক। জনস্বাস্থ্য সেখানে ব্রাত্য। তাই আয়ুষ্মান ভারতের নামে হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভোট চান, কিন্তু স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপনী প্রতিজ্ঞায় ডেঙ্গি প্রতিরোধের কথার উল্লেখ করার ভাবনাটাই মনে আসে না। অথচ জনস্বাস্থ্য হল জন-নীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জনস্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জন-নীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে তা জনস্বার্থের পরিপন্থী হয়।
সেন্টার অব সোশ্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy