যে সময়ে আমাকে ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়া হচ্ছে, সেই সময়টা সঠিক বলে আমি মনে করছি না। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
গত মঙ্গলবার, অর্থাৎ ২৫ তারিখ আমার কাছে একটি ফোন আসে। হিন্দিতে জানানো হয়, আমাকে পদ্মসম্মান (পদ্মশ্রী) দেওয়া হবে। জানতে চাওয়া হয়, এতে আমার সম্মতি রয়েছে কি না। সবিনয়ে জানাই, আমি খুবই সম্মানিত আমার নাম বিবেচনা করার জন্য। কিন্তু এই সম্মান গ্রহণ করতে আমি সম্মত নই। এর পর ফোনে জানতে চাওয়া হয়, আমার এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী? সে দিন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিকে যা বলেছিলাম, আনন্দবাজার অনলাইনে সে কথাই লিখছি।
আমি বলেছিলাম, এই সম্মান আমার অন্তত ১৫ বছর আগে পাওয়া উচিত ছিল। আমার যে ‘প্রোফাইল’, তা তো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রয়েইছে। তাতে তো দেখা যায় যে, এত বছর ধরে সঙ্গীতের জন্য, দেশের জন্য আমি কী কী করেছি। দেশের অন্তত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেশ কিছু বর্ষীয়ান শিল্পী আমার নাম প্রস্তাব করেছিলেন ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানের জন্য। কিন্তু যে সময়ে আমাকে ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়া হচ্ছে, সেই সময়টা সঠিক বলে আমি মনে করছি না। আরও আগে আমার এই সম্মান পাওয়া উচিত ছিল।
কেন্দ্রের তরফে যিনি আমাকে ফোন করেন, তিনি বলেছিলেন, আমার বার্তা তিনি উপরমহলে পৌঁছে দেবেন। এর পর তিনি ফোন রেখে দেন। পরে সন্ধ্যায় আবার ফোন আসে। জানতে চাওয়া হয়, আমি সিদ্ধান্ত বদল করছি কি না। বলি, আমি আগের অবস্থানেই অনড়। এ পর্যন্তই কথোপকথন।
সত্যি বলতে, কারও প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। আমি দেশের জন্য, রাজ্যের জন্য কাজ করতে চাই। সুযোগ পেলে আমি আমার তবলা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেব।
সাম্প্রতিক এই ঘটনার পর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এবং পণ্ডিত শিবকুমার শর্মাও বলেছেন, এই সম্মান আমার আরও অনেক আগে পাওয়া উচিত ছিল। ওঁরা বলেছেন, ‘‘আজকে অনিন্দ্যকে যে সম্মান দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার জন্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ওর অনেক জুনিয়র এই সম্মান পেয়ে গিয়েছে। আজ ওকে এই সম্মান দেওয়ার কথা ভাবা উচিত হয়নি। বরং পদ্মভূষণের জন্য ওর নাম বিবেচনা করা উচিত ছিল।’’ দেশের সিনিয়র মিউজিশিয়নরা যা মনে করছেন, তার সঙ্গে সহমত না হওয়ার কোনও জায়গা নেই।
গুরুজিদের কাছে যেটুকু শিখেছি, সেই পুঁজি সম্বল করে দেশবিদেশের বহু জায়গায় অনুষ্ঠান করেছি। কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, উস্তাদ বিলায়েৎ খান, উস্তাদ আমজাদ আলি খান, গাঙ্গুবাই হাঙ্গল, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা বা পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া— কার সঙ্গে অনুষ্ঠান করিনি! সেই সঙ্গে বিশ্বের বহু জায়গায় একক অনুষ্ঠান করেছি। জাকিরভাই এবং আমার নামে সিলেবাস দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। যেখানে আমাদের বাদনশৈলী নিয়ে পড়ানো হয়। ফলে জীবনের কাছে আক্ষেপ নেই।
এখানে একটা মজার গল্প বলি? যে বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারত সফরে এসেছিলেন, সে বার রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠানের জন্য আমায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাজনা শুনে ওবামা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আমেরিকা যাই কি না। বললাম, বহু বার গিয়েছি। একাধিক প্রদেশে অনুষ্ঠানও করেছি। বাজনা শুনে মুগ্ধ ওবামা আমাকে আমেরিকার সাম্মানিক নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিলেন।
বাংলা এবং দেশের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা আছে। সঙ্গীত, বিশেষ করে ফারুকাবাদ ঘরানার বাদনশৈলী পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে চাই। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার জমি দিলে অ্যাকাডেমি গড়ে সেখানে বিনাপয়সায় ছেলেমেয়েদের শেখাব। যে ভাবে আমি পুত্র অনুব্রতকে তৈরি করেছি, সে ভাবেই ছাত্রদের তৈরি করব। যতটুকু আমি নিজে শিখেছি, তা ওদের হাতে তুলে দিয়ে যেতে চাই। কিন্তু এটা ‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করার সঠিক সময় বলে মনে করছি না। আমার কোনও ‘পদ্মসম্মান’-এর প্রয়োজন নেই।
জীবন থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। প্রায় ছয় দশক ধরে ৬০টিরও বেশি দেশে অনুষ্ঠান করার সুযোগ হয়েছে। নিউ ইয়র্কের কার্নেগি হল, লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, রয়্যাল, সিডনি অপেরা হাউস কিংবা মস্কোর বলশই ব্যালে থিয়েটারের মতো জায়গায় অনুষ্ঠানের স্মৃতি এখনও টাটকা। অন্তত সাত থেকে আট হাজার কনসার্টে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। দেশের মানুষের জন্য একাধিক অনুষ্ঠান করেছি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য অর্থসংগ্রহ, রক্তদান শিবিরের জন্য অনুষ্ঠান, থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার জন্য অনুষ্ঠানের পারিশ্রমিক দান করা, কোভিডের সময় শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো— কী করিনি! এর পর সরকারের কাছ থেকে এটা আশা করিনি। সে জন্য মন সায় দেয়নি এই সম্মান গ্রহণ করতে।
দীর্ঘ দিন ধরে ছাত্র তৈরির কাজ করছি। বেশ কিছু ছাত্র ইতিমধ্যেই তৈরি করেছি, যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাজাচ্ছে। তাদের কাছ থেকেও অপার ভালবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা পাই। আর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা ধরলে তা-ও নিছক কম পাইনি।
এর পর রয়েছেন আমার শ্রোতারা। যাঁদের জন্য আমি বাজাই। এত বছর ধরে যাঁদের জন্য অনুষ্ঠান করি। স্টেজে বসার পর যখন হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে, পর্দা ওঠে, নমস্কার করার সময় যখন উল্টো দিকের অন্ধকার থেকে হাততালির শব্দ ভেসে আসে কিংবা জটিল কোনও তেহাই যখন সমে ফেরে এবং তা যখন দর্শকের তারিফ আদায় করে, তখন যে অনুভূতি হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা শক্ত। সম্মান, পুরস্কার এই স্বীকৃতির তুলনায় যেন তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমি এই জগতে বিচরণ করি।
শেষে বলব, প্রত্যেকেই যেন যোগ্য সময়ে সম্মান পান। পদ্মসম্মানের জন্য আমার নাম বিবেচনায় অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সে জন্যই এই সম্মান গ্রহণ করিনি। যদিও আমার বাজনা বা সঙ্গীতের জগৎ এই পার্থিব প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অনেক ঊর্ধ্বে। আমি সেই জগতেরই মানুষ। সেখানেই থাকতে চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy