৭৫ বছর আগে আছড়ে পড়া দু’টি পরমাণু বোমার প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছেন হিরোশিমা ও নাগাসাকির সাধারণ মানুষ। তেজস্ক্রিয়তায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর অনেকের পরবর্তী প্রজন্মের শরীরেও সেই প্রভাব অটুট থেকেছে। ঘটনার বহু বছর পরেও ক্ষয়ে যাওয়া ইমিউনিটি নিয়ে বাঁচা জাতির অগুনতি মানুষকে কোভিড বিপন্ন করতে পারত, ঠিক যে ভাবে বিপন্ন করেছে আমেরিকা তথা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে। কিন্তু বিগত কয়েক মাস ধরে ঠিক উল্টোটা ঘটছে। গত মে-জুন মাস থেকেই একটা প্রশ্ন বিজ্ঞানীমহলে সাড়া ফেলেছে— সূর্যোদয়ের দেশে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এত কম কেন?
জাপান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা, এবং সারা বিশ্বের মধ্যে এই দেশে গড় আয়ু সর্বাধিক। বিশ্বশান্তি সূচকে এই রাষ্ট্রের স্থানও সর্বোচ্চ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষত প্রযুক্তি, যন্ত্রবিদ্যা ও বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় জাপান অগ্রণী রাষ্ট্র। যদিও দেশটিতে রয়েছে বিপুল ঘন জনবসতি, ইটালির মতো বার্ধক্যজনিত ‘পপুলেশন পিরামিড’, তবু জাপানের তালিকায় কোভিডে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা অনেক কম। আর একটি তুলনামূলক বিচার আমাদের নাড়া দেয়— জাপানের রাজধানী টোকিয়ো শহরের জনঘনত্ব আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি এবং ৬৫ বছর বয়সিরা দেশের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ হলেও নিউ ইয়র্কের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ১৫ শতাংশ। তবু নিউ ইয়র্কে কোভিড অতিমারি যে বিপর্যয় ঘটিয়েছে, সে তুলনায় টোকিয়োতে কিছুই হয়নি। যে দেশে বিপুল ঘন জনবসতির জন্য সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানা প্রায় অসম্ভব, সেই জাপানের নাম কোভিড অতিমারির তালিকায় প্রথম দশেও নেই।
জাপানে কোনও কড়া লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব মানা হয়নি, তা হলেও কেন জাপান অতিমারিতে বিপর্যস্ত নয়? প্রাথমিক কারণটি হল, জাপানি সংস্কৃতি অজ্ঞাতেই ভীষণ ভাবে অতিমারির গাইডলাইন মেনে চলে। জাপানিরা যেমন করমর্দনে অভ্যস্ত নন, তেমন প্রায় সারা বছর বায়ুদূষণের কারণে অধিকাংশ জাপানি মাস্ক ব্যবহার করে থাকেন। জাপান যে হেতু মহাসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত, জাপানিদের খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে প্রধানত আনাজ এবং সি ফুড-এর ওপর। দ্বিতীয় স্থানে আছে পাখিজাত মাংস এবং সামান্য পরিমাণ লাল মাংস। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব জাপানিদের এই খাদ্যাভ্যাসের প্রধান কারণ হলেও, ইতিহাস বলে, বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভের আগে থেকেই জাপানে মাংস খাওয়ার ব্যাপারে অনীহা ছিল। ইদো যুগে ইয়োতসুশি বা চারপেয়ে জন্তু খাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। এ ছাড়া যে হেতু কোভিড ছাড়াও ২০০৯ সালে মেক্সিকান সোয়াইন ফ্লু-র সময়েও জাপানে ‘আর-ও’ বা ডিজ়িজ় ট্রান্সমিশন পৃথিবীর গড় ট্রান্সমিশনের থেকে কম ছিল, তাই আরও কিছু কারণের অবতারণা করা দরকার বিষয়টি পরিষ্কার বোঝার জন্য।
করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন আমাদের শরীরের কোষের এসিই২ রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয় শরীরে প্রবেশ করার জন্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে যে, সরাসরি প্রমাণিত না হলেও দেখা গিয়েছে জাপানিদের আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট-এ এসিই২ রিসেপ্টরের সংখ্যা কম। আবার জাপানিরা কোভিড অতিমারি শুরুর বেশ কিছু আগে থেকেই বিভিন্ন রকম সার্স ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন। তার ফলে, সার্স-কোভ-২’র বিবর্তনসংক্রান্ত গবেষণা বলছে, পৃথিবীর প্রায় সাড়ে তিন হাজার করোনাভাইরাসের জেনেটিক বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে, জাপানের করোনাভাইরাসের জিনোমগুলোর বিবর্তন বা মিউটেশন কম এবং প্রতিটি জিনোম ভীষণ ভাবে এক রকমের। এর ফলে ভাইরাসের আক্রমণ করার শক্তি হয়তো এ ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। তা ছাড়া জাপানিদের শরীরে এক ধরনের ইমিউনিটি আছে একটি বিশেষ প্রোটিনের উপস্থিতির কারণে, যার দরুন করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটিকে বলা হয় এইচএলএ বা হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন, যা শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহু গুণ বাড়িয়ে তোলে।
আজ কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে সারা পৃথিবী বিচলিত। পোলিয়ো, স্মলপক্স, অ্যানথ্রাক্সের মতো কোভিডের রোগ নির্মূলকারী টিকা আবিষ্কারের আশায় পৃথিবীর তাবড় বৈজ্ঞানিকরা। যক্ষ্মার বিসিজি টিকাও আবার এর পাশাপাশি কোভিড অতিমারিতে বহু আলোচিত। কারণ, সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, জাপান, চিন, ভারত, কোরিয়া, বা রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে, যেখানে শিশুদের বিসিজি টিকা দেওয়া হয়, সেখানে কোভিড অতিমারি তুলনামূলক ভাবে কম ভয়ঙ্কর হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, চিন কিন্তু প্রথম লড়াই করেছিল অজানা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। সেই দিক থেকে বিচার করলে, চিনের মৃত্যুহার অনেক কম। একই রকম ভাবে জাপানের ক্ষেত্রেও বিসিজি টিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে বৈজ্ঞানিকরা মনে করছেন। আজ সারা পৃথিবীতে যেখানে করোনাভাইরাসে মৃত প্রায় ৭,৭৬,০০০, সেখানে জাপানে এখনও ১৫০০ ছাড়ায়নি। জাপানে মোট জনসংখ্যা সাড়ে বারো কোটি। মার্চে অতিমারিকে আটকাতে জাপানে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে তিনটি ব্যবস্থা করা হয়, যার মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধের পাশাপাশি ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ ছিল অন্যতম।
১৯৪৫ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের নির্দেশে বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে ফেলা ‘লিটল বয়’ নামক বোমাটি প্রায় ৫০০ মিটার উঁচুতে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দেড় লক্ষ নিরীহ জাপানি নিহত হন। সেই সময় জাপানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলেও, জাপানের সাধারণ মানুষ এই হার মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। জাপানে এখনও ৫০,০০০ মার্কিন সেনা আছে। আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিহত সংখ্যাটাই উল্টে আমেরিকার গায়ে আটকে গিয়েছে কোভিড অতিমারিতে। হার-না-মানা জাপানিরা কোভিড অতিমারিতেও অপরাজেয়। গত বছর জাপানে শতায়ু মানুষ ছিলেন ৭১,২৩৮ জন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। আশা করি, এই বছর সংখ্যাটা আরও বাড়বে। ভুল প্রমাণ করবে কোভিড অতিমারির বয়সসীমার গণ্ডিকে।
এপিডেমিয়োলজি বিভাগ, জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy