বাংলায় অধ্যাপনার জন্য ইন্টারভিউ নিচ্ছি। প্রথম বিভাগে প্রথম, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এক তরুণের সাক্ষাৎকারে এসরাজের প্রসঙ্গ উঠেছিল। জানতে চেয়েছিলাম, এসরাজ কী? তিন বার প্রশ্ন করেও উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, “কিছু একটা তো বলবে, খায় না মাথায় দেয়?” তড়িৎগতিতে জবাব এসেছিল, “মাথায় দেয়।” পোস্টগ্র্যাজুয়েট ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়? উত্তর এল, তামিলনাড়ুতে। এমন অভিজ্ঞতা অনেক শিক্ষকের আছে। এ সব নিয়ে মাথা না ঘামানোটাই দস্তুর এখন।
ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক রবীশ কুমার সম্প্রতি কলকাতায় ষষ্ঠ ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা (২০১৯) দিলেন। এনআরসি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের উত্তরসূরি বাঙালির নীরবতার কারণ খুঁজছিলেন তিনি। প্রশ্ন করেছিলেন, যে বাঙালি জনগণমন লিখেছে, ভারতমাতার ছবি এঁকে দেশকে উপহার দিয়েছে, ‘জয় হিন্দ’ প্রথম ব্যবহার করেছে, মননচর্চায় অগ্রণী সেই বাঙালির বৌদ্ধিক সত্তার আজ এই দুর্দশা কেন? রবীশ কুমারের মতে, তার অন্যতম কারণ উচ্চশিক্ষার অবনমন।
এই অবনমন শুধু বাংলাতেই হয়েছে, এমন নয়। চোখ-কান খোলা রাখলে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আমরা শিখতে পারব, স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির নাম জওহরলাল নেহরু; দক্ষিণ ভারতের দু’টি রাজ্যের নাম বিহার ও অরুণাচল প্রদেশ; যে সরকারি প্রতিষ্ঠান চন্দ্রযান-২ পাঠিয়েছিল তার নাম মোদী সরকার! ইতিহাস অনার্সের ছাত্র ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সাল বলতে পারে না, বাংলা অনার্সের ছাত্রী একটাও উপন্যাস চোখে দেখেনি, একুশ বছরের এমএ-র ছাত্র জীবনে এক বার খবরের কাগজ দেখেছে বটে, কিন্তু পড়েনি। অথচ এই ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বর বেশ উঁচু। আশি-নব্বই শতাংশও আজকাল পাওয়া যায়। এর জন্য বই পড়া, লাইব্রেরি যাওয়া, এমনকি নিয়মিত ক্লাসে যাওয়ারও দরকার নেই। বাজারের নোটবই আর টিউশনির নোট পরীক্ষা বৈতরণি পার হওয়ার উপযুক্ত সাঁকো। প্রশ্ন ছকে বাঁধা। প্রচুর অপশন। ‘মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন’-ও রয়েছে। ইউজিসি ইদানীং যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখতে চায় প্রশ্ন ও পরীক্ষাপদ্ধতি।
বিশ্ববিদ্যার চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। তার লক্ষ্য এমন মানুষ তৈরি করা, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে পরিচ্ছন্ন, সচেতন। নিজের মত ও বিচারশক্তির ওপর থাকবে পূর্ণ আস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জীবন যাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে সত্যের প্রতিষ্ঠা দেবে। বাস্তবকে চিনতে গিয়ে মূল বিষয়গুলি বুঝবে, পরিহার করবে যা কিছু অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক। চিন্তার গভীরতা দিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথ খুঁজবে। সর্বোপরি তার এই মননশীলতাকে উপযুক্ত শব্দে ও বাক্যে প্রকাশ করতে পারবে। ভারতে দু’চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আছে, যেখানে প্রশ্ন ওঠে, তর্ক হয়। প্রতিবাদ ভাষা পায়। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারে দেখি, দারিদ্র নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয় জেএনইউ-তে পড়তে গিয়ে। সেখানে আজও দর্জি, ছোট দোকানদার বা সিকিয়োরিটি গার্ডের সন্তানেরাও পড়তে আসে।
টিউশন-নির্ভর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও তো বেশির ভাগ প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। তাকে আমরা এসরাজ ‘মাথায় দিতে’ শেখালাম। ‘খায় না মাথায় দেয়’— অতি সাধারণ বাংলা লব্জটিও কোনও দিন শুনতে পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারলাম না। বরং কেড়ে নিলাম তার চিন্তা করার ক্ষমতাটুকুও। প্রশ্নের ধরন দেখেও সে কিছু আন্দাজ করতে পারল না। অথচ সে হবু অধ্যাপক।
রবীশ কুমার যাদবপুর, জেএনইউয়ের বাইরে ‘বাঁকুড়া-মোতিহারি-মুজফ্ফরপুর-সুরাত’-এর কলেজের কথা ভাবতে বলেছিলেন। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখন র্যাঙ্কিংয়ের জালে বাঁধা। কত ছাত্র ভর্তি হচ্ছে আর কত পাশ করছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফেল করানো শিক্ষকের পক্ষে সহজ নয়। বিদ্যাচর্চা তো প্রায় অপরাধ। এক প্রবীণ অধ্যাপককে শুনতে হয়েছে, ‘‘আপনাকে প্রশ্ন করতে কে বলেছে? আপনি তো ক্লাসে যাবেন, লেকচার দিয়ে চলে আসবেন।’’ ছাত্রের মনও তৈরি নয় বিদ্যাচর্চার জন্যে। সে জেনে এসেছে নম্বরই মোক্ষ। তার উপায় টিউশনির নোট বা সহায়িকা।
একে তো অর্থনীতির উদারীকরণের সময় থেকে টেকনো-ম্যানেজেরিয়াল শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে। মূল্য কমেছে সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের। ছাত্রেরা যে খুব খুশি হয়ে এ সব বিষয় পড়তে আসে, তা-ও বলা যায় না। অন্য কিছু না পেয়ে আসে। অনেক ছাত্রছাত্রী, বিশেষত দলিত, সংখ্যালঘু ও মেয়েরা, বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয় পড়ার অর্থ জোগাড় করার কথা চিন্তা করতে পারে না বলেও মানববিদ্যার ক্লাসে নাম লেখায়। কিন্তু তার পর কী শেখে তারা চার-পাঁচ বছরে? জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণির বিভক্ত সমাজে তাদের জীবনের মানেটাই বদলে দিতে পারত উচ্চশিক্ষা। কিন্তু তিন কি পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেও তারা শিক্ষার বৃত্তে প্রবেশ করতে পারে না।
‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’-র ছাত্র এই জন্যই বাড়ছে। সাঙ্ঘাতিক সমস্ত খবর আমরা মুহূর্তে গিলে ফেলি, সে কাশ্মীর নিয়ে হোক বা যাদবপুর-জেএনইউ নিয়ে। রাজনৈতিক দলের তৈরি প্রোপাগান্ডায় সহজে বিশ্বাস করি। কারণ প্রশ্ন করতেই তো তাদের শেখানো হয়নি। আমাদের সৃজনশীলতা নেই, তাই মৌলিক ভাবনাও শেষ হতে বসেছে। রবীন্দ্রনাথ না পড়ে, শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলা বাঙালিকে রবীশ কুমার মনে করিয়ে দিলেন যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংস্কৃতি রক্ষা হয় না। আমরা কবে বুঝব?
বাংলা বিভাগ, মেদিনীপুর কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy