সদ্য জাপান থেকে ফেরা বন্ধু একটা অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিলেন। এক দিন সে দেশের মেট্রোরেলে সফরের সময় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন তিনি। হঠাৎ নজর করলেন আশপাশের সহযাত্রীরা অদ্ভুত ভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে ভেবে যখন সংক্ষেপে কথা সেরে ফোনটা রাখলেন, তখন পাশে দাঁড়ানো জাপানি সহকর্মী খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, জাপানে রেল বা বাসে সফরকারীরা সাধারণত ফোনে কথা বলেন না। জরুরি কিছু হলে টেক্সট মেসেজ পাঠান। কারণ ফোনে জোরে কথা বললে সহযাত্রীদের অসুবিধে হতে পারে! লোকাল ট্রেনের কথা ছেড়েই দিলাম, বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরের প্রিমিয়াম লাউঞ্জে বিশ্রাম করতে করতে যখন পাশের সহযাত্রীর সঙ্গে তাঁর লিভ-ইন পার্টনারের যাবতীয় অশান্তির খুঁটিনাটি জেনে যাই, তখন এমন ফোন-শিষ্টাচারের গল্প সত্যি বলে বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে পড়ে।
নাগরিকসুলভ শিষ্টাচারের বোধ বা ‘সিভিক সেন্স’ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নয়। এই বোধ ছোটবেলা থেকে জাগিয়ে তুলতে হয়। কথায় বলে, শিশুরা নাকি কিছুই নিজে থেকে শেখে না, তারা অনুকরণ করে মাত্র। যাঁদের অনুকরণ করে, তাঁরাও কি এই নাগরিক শিষ্টাচারগুলোর যথাযথ অনুশীলন করেন? ভারতের অন্তত শহর-কেন্দ্রিক আবহে, তথাকথিত শিক্ষিতদের মধ্যে কি সত্যি দেখা মেলে সিভিক সেন্স-এর? চারপাশে তাকিয়ে দেখলে এই প্রশ্নের উত্তরে একটি অতিকায় ‘না’ ছাড়া কিছু নজরে আসে না। প্রথাগত শিক্ষা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এই নাগরিক শিষ্টাচারের যে, সমানুপাতিক না হোক, আদৌ একটা সম্পর্ক আছে, সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। কারণ বোর্ডিং-এর সময় প্রায়ই দেখি যাত্রিবাহী বিমানের দু’পাশে দুই সারি সিটের মাঝখানের জায়গাটি প্রায় অবরুদ্ধ করে চলছে গল্পগুজব, বা কষা হচ্ছে পছন্দমতো সিট বেছে নেওয়ার অঙ্ক। আর পিছনে যাত্রীদের লাইনটি হয়ে চলেছে দীর্ঘায়িত। গণহারে অসভ্যতার নমুনা চোখে পড়ে প্রতি বছর ভারতীয় রেলের তোয়ালে, চাদর, এমনকি টয়লেটের মগ চুরি যাওয়ার আকাশছোঁয়া পরিসংখ্যান দেখলে। রাস্তাঘাটে থুতু ফেলা থেকে শুরু করে রাস্তায় স্কুটার রেখে লম্বা যানজট সৃষ্টি করা, বাড়ি বানাতে গিয়ে বালি ফেলে রাস্তার অর্ধেক হজম করে ফেলার মতো ব্যাপারগুলো এখন মোটামুটি গা-সওয়া। বরং প্রতিবাদ হতে দেখলে মনে হয় প্রতিবাদকারী আদৌ এই গ্রহের বাসিন্দা তো?
অনেকে মিলে এক জনকে পিটিয়ে মারলে যেমন ব্যাপারটা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মরক্ষার বিপ্লব হয়ে উঠতে পারে, তেমনই অনেকে মিলে একই ধরনের অসভ্যতা করতে শুরু করলে সেই অশিষ্ট আচরণগুলোই খুব স্বাভাবিক সামাজিক প্রতিক্রিয়ার রূপ নিয়ে ফেলে। এর নিখুঁত নিদর্শন দেখা গেল জনতা কার্ফু-র দিনে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ, হাউজ়িং কমপ্লেক্স-এর সামনে প্রায় জনা পঞ্চাশেক পূর্ণবয়স্ক এবং শিক্ষিত মানুষ থালা, বাটি, ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন। জমায়েত করতে নিষেধ করার পরে শোনা গেল অকাট্য যুক্তি— কেন? সবাই তো করছে! এর পর কিছু বাড়ির ছাদে এবং কমপ্লেক্স-এর মাঠে শুরু হল বাজি পোড়ানো। বিকেলের আকাশ ভরে গেল ধোঁয়ায়, শব্দে আর সালফারের গন্ধে। সেখানেও বারণ করা হলে শোনা গেল একই যুক্তি। রাতের দিকে সমাজমাধ্যমে ভেসে বেড়াতে লাগল আরও অনেক অসভ্যতার নজির। এমনকি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করে হেনস্থার খবরও।
ভারতের স্বনামধন্য আইনজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদ নানি পাল্কিওয়ালা এক বার জাপানের এক মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, ভারতীয়রা গড় মেধা বা বুদ্ধিবৃত্তিতে জাপানিদের সমকক্ষ হওয়া সত্ত্বেও জাপান এত উন্নত দেশ, অথচ ভারত দারিদ্রহার-সহ বহু সূচকের নিরিখে এত পিছনের সারিতে কেন? মন্ত্রীর চটজলদি জবাব ছিল, এর মূল কারণ হল জাপানে ১০ কোটি জাপানি নাগরিক বাস করেন, আর ভারতে থাকেন ১০০ কোটি স্বতন্ত্র মানুষ!
জমি কেনার দলিল বা জন্মের শংসাপত্র দেখিয়ে নাগরিকত্ব হয়তো প্রমাণ করা যায়। কিন্তু কাগুজে নাগরিকত্ব থাকলেই যে নাগরিক শিষ্টাচারবোধের উন্মেষ হয় না, সে কথা স্বতঃপ্রমাণিত। সেই বোধ উঠে আসে সহনাগরিকদের প্রতি মমত্ব, শ্রদ্ধা, এবং সহিষ্ণুতার অনুভূতি থেকে। আজ অতিমারির প্রকোপে গোটা পৃথিবীর যখন গভীর অসুখ, তখন এই বিকল হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো ফিরে পাওয়া খুব দরকার। দরকার শুধুমাত্র নিজের নয়, চারপাশের মানুষগুলোর কথাও ভেবে প্রতিটা পদক্ষেপ করার। তাঁরা আমাদের পরিবারভুক্ত না-হলেও আমাদের ভালমন্দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন সংক্রমণের নিয়মে। জনস্রোতে গা ভাসিয়ে গণ-অসভ্যতার যে ঐতিহ্য আমরা বহন করে আসছি, তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিসর্জন না দিলে, এই মৃত্যুমিছিলের পিছনে শুধু বিদেশাগত নোভেল করোনাভাইরাসের নয়, আমাদেরও সমান দায় থেকে যাবে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy