বহু দিন আগের কথা। বছরটা ১৯৪৬। কৃষিচাষের তিন ভাগের দু’ভাগ ভাগচাষিদের দিতেই হবে, এই দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ। জমিদার, জোতদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ভাগচাষিদের কৃষিচাষের অর্ধেকেরও বেশি জোতদারদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে প্রতিবাদ, শুরু হয় তেভাগা আন্দোলন। এই সময়, বাংলার এক কৃষক পরিবারের বিধবা গৃহবধূ, মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের বিমলা মাঝি। গ্রামের মহিলাদের সংগঠিত করেন, গড়ে তোলেন ‘ঝাঁটা বাহিনী’, যা হয়ে ওঠে জোতদারদের আতঙ্কের কারণ।
বিমলা মাঝির রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময়, যখন তিনি যোগ দেন মণিকুন্তলা সেন পরিচালিত ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’তে, গঠন করেন মহিলা বাহিনী, আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেন গ্রামের মহিলাদের। তেভাগা আন্দোলনের শুরুর দিকে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র পক্ষ থেকেই আন্দোলনে যোগদান করেন তিনি, কিন্তু আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিযুক্ত হয়ে যায় তাঁর প্রতিবাদ। তিনি গড়ে তোলেন মেদিনীপুরের অসংখ্য মহিলা সমিতি, এবং শুরু করেন ‘ঢেঁকি প্রকল্প’, যেখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ধান ভানার কাজ করে, সেই চাল বাজারে বিক্রি করতেন মহিলা সমিতির মহিলারা। এই মহিলা সমিতির মেয়েদের নিয়েই বিমলা পরবর্তী কালে গড়ে তোলেন ‘নারী বাহিনী’ বা ‘ঝাঁটা বাহিনী’। এই বাহিনীর অন্যতম কাজ ছিল ঝাঁটা, লঙ্কাগুঁড়োর মতো অস্ত্র-সহযোগে গিয়ে জোতদারদের ধানের গোলা, ঢেঁকি নষ্ট করে, তাদের জমিয়ে রাখা ধান মহিলা সমিতির গোলায় এনে তোলা। ১৪০টি পুলিশ কেস, আড়াই বছরের অত্যাচার ও কারাদণ্ডও স্থগিত করতে পারেনি বিমলার এই আন্দোলনকে।
তার পর কেটে গেছে ৭৪ বছর। কৃষকরা আবারও অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে মুখর। দিল্লির প্রবল শীতে প্রতিবাদী কৃষকদের পাশে বসে আছেন কৃষক পরিবারের মহিলারা, সারা ভারত দেখছে সেই ছবি। মাথায় ওড়না টানা, মুখের পেশি শক্ত করে বসে থাকা, কমবয়সি বধূদের সাবধানে রেখে সামনে বসেছেন বয়স্করা। কত টন আটা এসেছে, তার রুটি তৈরি হচ্ছে, ছবি দেখতে পাচ্ছে দেশ। অসংখ্য হাত রুটি বেলছে, বিরাট তাওয়ায় সেই রুটি সেঁকা হচ্ছে। কী পদ্ধতিতে, কোন ব্যবহার্যকে ব্যবহার করে রুটি করা হচ্ছে, তাই নিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে আলোচনা সেরে নিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। যে গৃহবধূ, তাঁর চেনা রসুই-এর পরিবর্তে ছাউনিতে বসে রুটি সেঁকছেন, তাঁর গল্প আন্দোলনের গর্ভেই ধিকিধিকি জ্বলছে হয়তো। যেমন জ্বলছে তিপান্ন বছরের মনদীপ কউরের গল্প। লুধিয়ানার এক গ্রামের গৃহবধূ তিনি, তাঁর স্বামী, বাবা, ভাই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন। টানা প্রতিবাদে থাকতে পারছেন না মনদীপ, কারণ সকলে চলে এলে নষ্ট হয়ে যাবে খেতের ফসল। তাই দু’তিন দিনের মতো জল, সার খেতে দিয়ে প্রতিবাদে যোগ দিচ্ছেন তিনি, আবার ফিরে যাচ্ছেন লুধিয়ানায়, চাষের দায়িত্ব নিতে। একই কাজ করছেন আটষট্টি বছরের সুখবিন্দর কউরও। যে দিন থাকছেন, সবার জন্য রান্না করে দিয়ে যাচ্ছেন চাট, ক্ষীর, পকোড়া। পঁচাত্তর বছর বয়সি দালজিন্দর কউর অবশ্য প্রতিবাদের ছাউনিতেই থাকছেন, গত কয়েক সপ্তাহের প্রবল শীত সহ্য করে।
দালজিন্দরের গল্প মনে করায় বিলকিস বানোর কথা। মনদীপ সুখবিন্দরদের গল্প মনে করায় আর এক আন্দোলনের কথা— সেখানেও দিল্লির প্রবল শীতে গৃহবধূরা বসেছিলেন অস্থায়ী ছাউনিতে, শত হুমকিতেও ভয় পাননি। সেই সময়টা বেশি দিন আগের নয়, মাত্রই এক বছর। নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের শাহিনবাগ আন্দোলনের সেই ছবি অতিমারি ঝাপসা করেছে, ভোলাতে পারেনি। বিলকিস বানো, ফিরদৌস শাফিকদের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে সিংঘু সীমান্ত। এখানে বসে অনলাইন ক্লাস করছে বাচ্চারা, আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঠিক যেমন ভাবে শাহিনবাগে বাচ্চারা হোমওয়ার্কের খাতা নিয়ে চলে আসত মায়ের কাছে। মা বা অন্য কেউ ঠিক স্কুলের পড়া তৈরি করিয়ে দিত, স্কুল থেকে ফেরা বাচ্চাদের মুখে রুটি তুলে দিত। মা’রা প্রতিবাদ করছেন, প্রতিবাদ করতে শিখত সন্তানেরা।
ছাউনিতে বসে রুটি সেঁকা পঞ্জাবি গৃহবধূ, বা শাহিনবাগের ফিরদৌসদের দেখে কি মনে পড়ে অনেক আগে শোনা, ভুলে যাওয়া বা ভুলতে চাওয়া সেই উদ্বাস্তু ক্যাম্পের কথা? পরিযায়ী শ্রমিকদের উৎখাতের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে দেশভাগের উদ্বাস্তুদের কথা— দেখিয়েছেন গবেষক অন্বেষা সেনগুপ্ত, তাঁর ‘ফোর্সড মাইগ্রেশন স্টাডিজ়’, বা ‘বর্ডার স্টাডিজ়’ নিয়ে করা কাজে।
বিমলা মাঝির কথা, খাদ্য আন্দোলনে শহিদ হওয়া মহিলাদের কথা হয়তো জানেন না পঞ্জাবি গৃহবধূটি, বা শাহিনবাগের মেয়েটি। কিন্তু প্রতিবাদের উত্তরাধিকার? জিনের স্মৃতি?
জোতদারদের অত্যাচার, শীতের জলকামান বা বুলেট উপেক্ষা করে বেঁচে থাকবে তেভাগা, শাহিনবাগ, সিংঘু। বেঁচে থাকবে কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy