ট্রাম্পের মন রাখতে ইনফোসিস ঘোষণা করল, ১০,০০০ মার্কিন নাগরিককে চাকরি দেবে তারা। সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ‘টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন হাব’গুলো তৈরি করবে বলে জানিয়েছে, তার প্রথম চারটে ইন্ডিয়ানায় হবে। ইন্ডিয়ানা ভাইস প্রেসিডেন্ট মিকি পেন্স-এর রাজ্য, এত দিন অবধি তার মূল খ্যাতি ছিল গোটা দুনিয়ায় মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি বাস্কেটবল খেলোয়াড় তৈরি করায়।
ইনফোসিস যে সময় দরজা খুলে দিল, ঠিক তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার তলানিতে— ৪.৪ শতাংশে। গত এক দশকে এত কম বেকারত্বের হার মার্কিন মুলুক দেখেনি। আর, ইনফোসিসের নিজের দেশ ভারতে রক্তক্ষরণ চলছেই। উইপ্রো সদ্য ৬০০ কর্মী ছাঁটাই করল; কগনিজ্যান্ট ৬,০০০ জনকে বিদায় করার কথা ভাবছে, ইনফোসিসই গত এক বছরে আট-ন’হাজার কর্মীকে ‘ছেড়ে দিয়েছে’। পরিসংখ্যানটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ভারতে ৩৯ লক্ষ কর্মী কাজ করেন— দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রের মোট কর্মীসংখ্যার সিকিভাগ তথ্যপ্রযুক্তিতেই। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সফ্টওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেস কম্পানিজ (ন্যাসকম)-এর আশঙ্কা, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বছরে ৩০ শতাংশেরও বেশি হারে বৃদ্ধি এখন অতীত— অদূর ভবিষ্যতে ৮-১০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি আশা করলে হতাশ হতে হবে।
ইন্ডিয়ানার ইনোভেশন হাবে ঠিক কী হবে? উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগানোর মতো বেশ কয়েকটা সমস্যা ইনফোসিসের হাতের কাছেই রয়েছে। তেমনই পাঁচটা চিন্তার কথা বলি।
যখন স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতেই সব কাজ হবে, তখনও মানুষের জন্য কাজের সুযোগ রাখা: ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে বেধড়ক ছাঁটাই হচ্ছে, তার একটা বড় কারণ যে ক্রমেই আরও বেশি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ঢুকে পড়া, তাতে সন্দেহ নেই। ম্যাকিনসে এক সমীক্ষা করে জানিয়েছে, এখনই যে প্রযুক্তিগুলো তৈরি হয়ে গিয়েছে, তা ব্যবহার করলেই বহু কাজ স্বয়ংক্রিয় ভাবে সেরে ফেলা যাবে। চিন, ভারত, জাপান আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মাত্র এই চারটে দেশেই তার ফলে বর্তমান কর্মীদের দুই-তৃতীয়াংশের চাকরি চলে যাবে, মাইনেবাবদ মোট খরচ কমে অর্ধেক হবে। এই চারটে দেশের মধ্যে একমাত্র ভারতেই তরুণ প্রজন্ম দলে ভারী, বাকি তিনটে দেশের জনসংখ্যার গড় বয়স ক্রমে বাড়ছে। সেখানে কর্মীর সংখ্যাও কমছে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি সে দেশের জন্য আদর্শ। ম্যাকিনসের হিসেব বলছে, ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরতদের মধ্যে অর্ধেকই আগামী চার বছরে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে যাবেন— অর্থাৎ, তাঁদের কাজ থাকবে না। বিশ্বের তরুণতম জনগোষ্ঠীর দেশে যেখানে এমনিতেই প্রায় নব্বই শতাংশ কর্মী অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, সেখানে এই খবরটা মারাত্মক।
কাজ চালানোর বাতিল মডেলটাকে নতুন ভাবে তৈরি করা: তথ্যপ্রযুক্তির ওপর শুধু স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির কালো মেঘই ঘনায়নি, আরও বিপদ আছে। ইনফোসিসের মতো সংস্থাগুলি তাদের ক্লায়েন্ট সংস্থার সফ্টওয়্যার তৈরি করে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করে বছরে ১৫,০০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে। এই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করা প্রোগ্রামাররা। এই মডেলটাই বাতিল হতে বসেছে। এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ সফ্টওয়্যারের যুগ, ‘ক্লাউড’-এর জোরে চলে। বাজার দ্রুত বদলাচ্ছে। ইনফোসিসের প্রতিযোগিতা আর শুধু উইপ্রো বা টিসিএস-এর মতো ঘরের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে নয়, বাজারে এখন আমাজন, ওরাক্ল, মাইক্রোসফ্ট আছে। আর আছে অনেক স্টার্ট আপ। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলো এর আগের সব ঝড়ই কমবেশি সামলেছে। কিন্তু এ বারে নতুন খেলা। ক্লাউড সার্ভিস, বিগ ডেটা, মেশিন লার্নিং আর কৃত্রিম ইনটেলিজেন্স-এর অমোঘ মিশেলে দুনিয়া এতখানি বদলেছে যে সেখানে টিকে থাকতে হলে নতুন দক্ষতা চাই, নিজেদের পরিষেবা বিক্রির নতুন পথ চাই, নতুন দাম চাই। নতুন পথে হাঁটা সব সময়ই কঠিন। বিশেষত, এত দিন যে পথে চলে সাফল্য এসেছে, তাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে।
শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া: সংস্থাকে যদি নতুন পথে হাঁটতে হয়, তবে কর্মীদের নতুনতর প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত করে নিতেই হবে। ভারতে প্রতি বছর গড়ে যে ৮০,০০০ ইঞ্জিনিয়র তৈরি হচ্ছে, তাদের সিংহভাগই এত কম তৈরি যে নতুন প্রযুক্তি দূরের কথা, তারা পুরনো প্রযুক্তিতেও সড়গড় নয়। ২০১১ সালে ন্যাসকম জানিয়েছিল, প্রতি বছর যত ছেলেমেয়ে ইঞ্জিনিয়র হচ্ছে, তাদের সিকি ভাগ চাকরি পাওয়ার যোগ্য। ছ’বছরে পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপই হয়েছে। এঁদের নতুন প্রযুক্তিতে কাজ করার যোগ্য করে তোলার খরচ এবং জটিলতা বাড়বে।
ডিজিটাল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা: সস্তায় প্রোগ্রামিং-এর ব্যবসার বাজার যখন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন ইনফোসিসের মতো সংস্থাগুলি কী ভাবে বাজারে নিজেদের জায়গা ধরে রাখবে, তার জন্য নতুন পথ খোঁজার সময় এসেছে। এত দিন বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক সংস্থা, আর টেলিকমিউনিকেশন শিল্প থেকেই ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তির অর্ধেক ব্যবসা আসত। ভবিষ্যতের চাহিদা তৈরি হবে অন্য ক্ষেত্রে— স্বাস্থ্য পরিষেবায়, রিটেলে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি ব্যবসা পরিচালনায় সহায়তা দেওয়ার কাজ করে, তাদের সঙ্গে এই গোত্রের সংস্থাগুলির যোগাযোগ অনেক বেশি।
ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি নিঃসন্দেহে চেষ্টা করছে এই পরিবর্তিত বাজারে মানিয়ে নিতে। বছর কয়েক আগেও ইনফোসিসের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম থেকে কোনও আয় হত না। এখন সংস্থার ৫-৬ শতাংশ রাজস্ব দেয় এই প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু, একটি সমীক্ষা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাক্সেঞ্চুয়ারের তুলনায় ভারতের আর দুটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টিসিএস ও উইপ্রোর ডিজিটাল সার্ভিসে কর্মীসংখ্যা ৫০ শতাংশ বেশি, উপার্জন ৪০ শতাংশ কম। অ্যাক্সেঞ্চুয়ারের ডিজিটাল ব্যবসায় কর্মীপিছু আয় তার প্রথাগত ব্যবসায় কর্মীপিছু আয়ের দ্বিগুণ। ইনফোসিসের মতো সংস্থায় দুটি ক্ষেত্রে আয়ের কোনও ব্যবধানই নেই। অর্থাৎ, ভারতীয় সংস্থাগুলি যে শুধু তুলনায় অনেক কম উৎপাদনশীলই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি মুনাফার বাজারেও সংস্থাগুলি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
দ্রুত বাড়তে থাকা বাজারকে ধরা: ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ৬০ শতাংশ রাজস্বই আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু, অন্য বেশ কিছু বাজার ঢের দ্রুত বাড়ছে। টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুলে আমরা একটা সূচক তৈরি করেছি— ডিজিটাল ইভোলিউশন ইনডেক্স। ডিজিটাল দুনিয়ার গতিবিধি মাপাই তার কাজ। সেই সূচকে দেখা যাচ্ছে, এশিয়ার বেশ কিছু দেশে ডিজিটাল বাজার দ্রুত বাড়ছে। ভারতীয় সংস্থাগুলির কাছে এটা একটা নতুন সুযোগ হতে পারে কি? আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কি এই দেশগুলোর দিকে তাকানো যায়?
এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা নেহাত সহজ নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিসা না দেওয়ার হুমকি দেওয়াতেই ইনফোসিস মার্কিন মুলুকে ১০,০০০ চাকরির ব্যবস্থা করছে, ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সংস্থাটির নিজের স্বার্থে এটা সেরা পদক্ষেপ, এমন কথা আমি মানতে রাজি নই। যে দেশের সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খরচের পরিমাণ কমাচ্ছে, এবং যে ক্ষেত্রটি ক্রমেই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির দখলে চলে যাচ্ছে, তেমন দেশে তেমন একটি ক্ষেত্রে চাকরি তৈরি করার জন্য বিপুল টাকা খরচ করা— এমন সিদ্ধান্তে বিচক্ষণতার পরিচয় খুঁজে পাওয়া কঠিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy