এই রাজ্যে, শহর থেকে দূরবর্তী এলাকায় যেখানে জমির দাম কম, সেখানে কোনও কোনও জায়গায়, উর্বর কৃষিজমিতে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকিয়ে ভেড়ি তৈরি করা হচ্ছে, চিংড়ি চাষের উদ্দেশ্যে। এক শ্রেণির দুষ্কৃতী চাষির জমিতে জোর করে নোনা জল ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে সেই জমি চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। কিছু দুষ্কৃতীর লোভের কারণে চাষির জীবিকা ও জীবন আজ সঙ্কটাপন্ন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে মেদিনীপুর— একই চিত্র।
বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে শহরে ও তার কাছাকাছি এলাকায়। যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার শাসনে ভেড়ি বোজানোর কাজ চলছে। শহরের কাছাকাছি অঞ্চলে জমির দাম আকাশছোঁয়া। সেখানে ফ্ল্যাটের চাহিদা আছে। তাই শহরের নিকটবর্তী জলাজমিগুলি ও শহরের অভ্যন্তরের জলাশয়গুলি বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে, ফ্ল্যাট তোলা হচ্ছে সেখানে। পুরনো বাড়ি ভেঙেও ফ্ল্যাট উঠছে বটে, কিন্তু বড় বড় আবাসনের জন্য নাগাড়ে জলাশয় বোজানো হচ্ছে। জলাশয় বোজানো হলে কী ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালিখি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পাল্টায়নি। অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় জলাশয় বুজিয়ে আবাসন গড়ে উঠছে, সেই আবাসনের ভিতরে চৌবাচ্চার মতো একটি জলাশয় রাখা হচ্ছে, মূল জলাশয়টির ক্ষতিপূরণ হিসেবে। সম্ভবত এই শর্তেই আবাসন গড়ার অনুমতি মিলছে। এবং ফ্ল্যাট বিক্রির সময় ক্রেতাকে বলা হচ্ছে— এটা সুইমিং পুল। একটা চক্র যে কাজ করছে, বোঝা যাচ্ছে। সকলে দেখেও না-দেখার ভান করে চলেছেন।
এর পিছনে প্রধান কারণটা হল এই যে, বাঙালি মধ্যবিত্ত ধারাবাহিক ভাবে কলকাতা ও শহরতলিতে তাঁর ঠিকানা স্থাপনের চেষ্টা করে চলেছেন। এই যে একটা ব়ড় শহরের ওপর মানুষের ভীষণ ভাবে হামলে পড়া, এটাকেই অর্থনীতিবিদ জন ডব্লিউ মেল্লার বলেছেন, ‘‘নগরায়ণের এক অস্বাস্থ্যকর গঠন’’। তাঁর মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে এই প্রবণতা বেশ প্রকট। সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, আজকের শিল্পোন্নত দেশগুলি এক দিন যখন উন্নয়নশীল পর্যায়ে ছিল, তখন সেই দেশগুলিতে এ জাতীয় ধারা পরিলক্ষিত হয়নি। তাদের ছোট ছোট অনেক শহর ছিল। সেগুলিও মানুষের পছন্দের ছিল। শুধুমাত্র বড় শহরের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ ছিল— এমন নয়।
এই রাজ্যে শহরকে কলকাতার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে, নাগরিক প্রকল্পের বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগ ছিল। তাঁর সৃষ্ট বিধাননগর যদিও কলকাতার গায়ে, দুর্গাপুর ও কল্যাণীর অবস্থান কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পরবর্তী কালে, বামফ্রন্ট কলকাতার গায়ে রাজারহাট-নিউটাউন নামে আর একটি বৃহৎ নগরীর পত্তন করে রাজ্যের তামাম শ্রমজীবী মানুষকে অবাক করে দিয়েছে। অভিজাত বামপন্থী সৌধ হিসেবে চিরকাল বিরাজ করবে এটি।
মফস্সলের মানুষ কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে বাস করতে চায় কেন? পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতা, প্রচুর অফিস-কাছারি। কলকাতার সঙ্গে চাকরিজীবী বাঙালির একটা ভাল অংশের তাই অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ। শিল্পবাণিজ্যে এখন ভাটা ঠিকই, কিন্তু যেটুকু টিমটিম করে জ্বলছে তাতে কলকাতার একটা ভূমিকা আছে। সরকারি-চাকরিমুখী বাঙালি কলকাতা-অন্ত প্রাণ। জীবনীশক্তি শুষে নেওয়া ভিড়ে ভর্তি ট্রেনে বাসে চেপে জীবিকার প্রয়োজনে জেলা থেকে বহু নিত্যযাত্রীর কলকাতায় আসা-যাওয়া। এই জীবনযন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এবং যাতায়াতের সময়টুকু বাঁচাতে, সুযোগ পেলে ও সামর্থ্যে কুলোলে, মানুষ কলকাতায় আস্তানা খোঁজার চেষ্টা করেন। এমনকী, শহরের নানা রকম দূষণের বিষ শরীরে ধারণ করতেও তাঁদের আপত্তি দেখা যায় না।
এ কথা ঠিক যে, গত দু’তিন দশকে বিভিন্ন রেল স্টেশনগুলিকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা মফস্সলগুলির চাকচিক্য অনেকটা বেড়েছে, জেল্লাদার শপিং কমপ্লেক্সও গড়ে উঠেছে, কিন্তু ভাল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও পরিষেবার ভীষণই অভাব। ভাল হাসপাতাল দূর অস্ত্। গ্রাম-মফস্সলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিও মানুষের সমীহ কম। কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে মফস্সলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রবেশ ঘটছে, তবে সেগুলির বেশির ভাগের মান সম্পর্কে সচেতন মানুষের সন্দেহ আছে।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে মেট্রোপলিটন মন শুধু নিজেকে এলিট নয়, বেশি সংস্কৃতিমান বলেও জাহির করেছে। মফস্সল মন তাই মেট্রোপলিটন মনে রূপান্তরের এক তাড়না অনুভব করেছে। মফস্সলের আস্তানা ছেড়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট কেনার পিছনে এই তাড়নাও কোনও ভাবে কাজ করেছে। এমন অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন যাঁরা এক সময় গ্রামে সাংস্কৃতিক রুচির প্রসারে কিছুটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। এঁরা চলে যাওয়ায় গ্রাম-মফস্সলে লুম্পেন সংস্কৃতি আগের চাইতে আরও জাঁকিয়ে বসেছে।
এটা ঠিক যে, কলকাতার আকর্ষণ আগের তুলনায় অনেকটাই লুপ্ত। তবু কলকাতার মায়া বাঙালি মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফ্ল্যাটের কারবারিরা সেটা বুঝে গিয়েছে। তাই ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে ওত পেতে বসে থাকে, মফস্সলের ক্রেতা এলেই তাঁকে সেই মায়ার জালে ফাঁসিয়ে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy