অস্ট্রেলিয়ার সেনেটর লারিসা ওয়ার্টার্স যাহা করিলেন, সে দেশের ইতিহাসে তাহা কেহ করে নাই। তাহার অর্থ অবশ্য এই নহে যে, পৃথিবীতেই এ কাজ কেহ করে নাই। গত অক্টোবরে আইসল্যান্ডে একই বিষয় লইয়া দুনিয়াজোড়া হইচই পড়িয়াছিল। ওয়াটার্স যেমন পার্লামেন্টে বসিয়া চুপচাপ নিজের দুই মাসের শিশুকে স্তন্যপান করাইতেছিলেন, আইসল্যান্ডের এমপি আবার পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দিতেই স্তন্যপান করাইয়াছিলেন। যুক্তি দুই জনেরই এক: কাজে ব্যাঘাত না ঘটিলে এত প্রয়োজনীয় কাজটি করা যাইবে না কেন? বক্তৃতা প্রদানকালীন ‘অন্য’ কাজ করিলে তাহা অমনোযোগিতা বলিয়া গ্রাহ্য কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ইঁহাদের মূল বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। কাজের ক্ষেত্রে নিজের বা অন্যের অসুবিধা না ঘটাইয়া পার্লামেন্টে বসিয়া স্তন্যপান করানো যাইবে না, ইহা একটি প্রাক্-আধুনিক যুক্তি। একবিংশ শতকে আসিয়া আর এই ঝরঝরে পুরাতন মূল্যবোধ লইয়া বসিয়া থাকিলে চলে না। ব্রিটেনে সম্প্রতি এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারির চেষ্টায় একটি বিতর্ক হয়। তাহাতে নিষেধাজ্ঞাবাদীরা আর কিছু না পাইয়া সেই পুরাতন মূল্যবোধকেই সরাসরি আঁকড়াইয়া ধরে। ঘটনাটি ভদ্রোচিত নয়, এই ছিল তাঁহাদের প্রথম যুক্তি। এবং, অন্যান্যরা আমাদের দেখিয়া হাসাহাসি করিবে, ইহা দ্বিতীয় যুক্তি।
একবিংশ শতকীয় মূল্যবোধ কিন্তু বলে, ‘ভদ্রোচিত’ কার্যের সংজ্ঞাটি ইতিমধ্যে ব্যাপক ভাবে পাল্টাইয়া গিয়াছে, তাহার প্রাসঙ্গিকতাও আমূল পাল্টাইয়াছে। কোনও কার্য যদি ‘অধিকার-ভুক্ত’ হয়, তবে তাহা ভদ্র অভদ্র যেমনই দেখাক, সমাজ তাহা গ্রহণ করিতে বাধ্য। মাতা শিশুকে কখন, কোথায়, কেমন ভাবে খাদ্য সরবরাহ করিবেন, তাহা মাতা স্থির করিবেন। সে যদি কোনও গণস্থান হয়, তাহাও সই। ইহার অন্যথা একান্ত ভাবেই মাতা ও শিশুর অধিকার ভঙ্গের পর্যায়ে পড়িবে। গণস্থানে ‘গণ’-র ভদ্রতাবোধে আঘাত পড়িলে তাহা একান্ত ভাবেই গণ-র সমস্যা, তাহাকেই চোখ সরাইয়া কিংবা বুজিয়া সহ্য করিতে হইবে। কিন্তু অধিকারে বাধা দেওয়া যাইবে না। ইহা কেবল নারী-স্বাধীনতার নামে আবদার বাড়াইয়া চলা নয়, মানবিক স্বাধীনতার প্রশ্ন। মানবিক অধিকারের প্রশ্ন। গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রশ্ন।
ব্রিটেন হইতে আইসল্যান্ড পর্যন্ত গত বৎসর এই বিষয়ে যে বিতর্ক দাবানলের মতো ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, অস্ট্রেলিয়ার ঘটনার অভিঘাতে তাহা আবার নূতন করিয়া ফিরিল। স্বভাবত রক্ষণশীল সমাজ হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিয়া অধিকার-পন্থী কণ্ঠগুলিকে কোণঠাসা করিতে চাহিতেছে। এমন একটি বিষয় লইয়া এত উত্তাপ সঞ্চারের ঘটনাটিই দুর্ভাগ্যজনক। এত দিনে ইহা স্বতঃসিদ্ধ হইয়া যাওয়া উচিত ছিল যে, কর্মক্ষেত্রে নারীর কতগুলি বিশেষ অসুবিধা থাকে বলিয়া কতগুলি বিশেষ স্বীকৃতি থাকাই স্বাভাবিক। শিশু যেহেতু মাতার উপর বেশ কিছু কাল নির্ভরশীল থাকে, এবং সেই গোটা সময় ধরিয়া যেহেতু মাতাকে কর্মক্ষেত্র হইতে নির্বাসিত রাখিবার প্রথাটি এত দিনে উঠিয়া গিয়াছে, সে ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে দরকারমতো শিশুর উপস্থিতি এবং শিশুর প্রয়োজনীয় যত্নদানও স্বীকার করিতে হইবে। পার্লামেন্টও একটি গণস্থান বা গণপরিসর মাত্র, তাহা হইতে মহত্তর কিছু নয়। সেখানেও এই অধিকার-বৈচিত্র্য আনিতে এবং মানিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy