ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। —ফাইল ছবি।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বীরসিংহ গ্রামে বাবা ঠাকুরদাসের সঙ্গে গ্রামের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এমন সময়ে মা ভগবতীদেবী অকাল বিধবা পড়শি কিশোরীর দুঃখে আকুল হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রে কাছে বিধবাদের বাঁচার উপায় জানতে চাইলেন। একই প্রশ্ন রাখলেন ঠাকুরদাসও। বিদ্যাসাগর জানালেন, এমন বিধবার আবার বিয়ে শাস্ত্র সিদ্ধ। এ বিষয়ে তাঁর বই লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সমাজে বিরোধের আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। ঠাকুরদাস ও ভগবতীদেবী দু’জনেই এগিয়ে যেতে বললেন।
শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, এই সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাঠাগারে সারা দিন ধরে নানা শাস্ত্র পড়তে শুরু করলেন। মাঝে এক বার শুধু খেতে উঠতেন। সালটা ১৮৫৩, শীতকাল। রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, এক দিন তাঁর সামনেই বিদ্যাসাগর ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি পেয়ে গিয়েছেন পরাশর সংহিতার দু’লাইনের একটা শ্লোক। ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ’ অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন।
এই মত সমর্থন করলেন বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান লেখক, ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ। এক বছর পরেই ১৮৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’-র সভায় হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ ও বাল্যবিবাহ বর্জন নিয়ে কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব আর অক্ষয়কুমার দত্তের সমর্থনের বিস্তারিত একটি প্রতিলিপি ব্রিটিশ লিগ্যাল কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছিল।
১৮৫৫ সালের জানুয়ারিতে বিধবা-বিয়ে নিয়ে লেখা বিদ্যাসাগরের বইয়ের প্রথম সংস্করণের দু’হাজার কপি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গেল। উৎসাহিত বিদ্যাসাগর আরও তিন হাজার বই ছাপালেন। সংস্কারাচ্ছন্ন পণ্ডিতেরা তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচনা শুরু করলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের মতের বিরুদ্ধে অসংখ্য চিঠি প্রকাশিত হতে শুরু করল। পাল্টা জবাব দিলেন বিদ্যাসাগর। বইটি সারা ভারতবর্ষে জুড়ে ঝড় তুলেছিল। বিদ্যাসাগরকে আরও দশ হাজার কপি ছাপাতে হয়েছিল। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে ৯৮৬ জনের সই নিয়ে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে বিধবা বিবাহের দাবি পেশ করলে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠল।
সেই সময়ের খবরের কাগজগুলি দু’ভাগ হয়ে গেল। শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-সহ অনেক প্রভাবশালী মানুষ সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। ব্যঙ্গ পদ্য বেরোল ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ পত্রিকায়, ‘‘...সাজ গো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল।/ তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকূল।’’ নামে, বেনামে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে বহু চিঠি প্রকাশিত হতে থাকল। প্রশ্ন উঠল, বিধবার গর্ভের সন্তান সম্পত্তির অধিকারী হবে কি না।
১৮৫৬ সালে বর্ধমান থেকেও বিধবা বিবাহের সমর্থকদের একটি আবেদন সরকারকে দেওয়া হল। বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ বিদ্যাসাগরের সমর্থনে সই করলেন। প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, প্যারীচাঁদ মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের সমর্থনে সরকারের কাছে আবেদন পাঠালেন। বিরুদ্ধে দরখাস্তের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ত্রিপুরা, পুণে, মুম্বই, উত্তর ভারত আর নবদ্বীপ থেকেই প্রায় তিরিশ হাজার প্রতিবাদ সরকারের দফতরে জমা পড়ল। সাবধান করে বলা হল, এমন বিয়ে চালু হলে ভারতে নিশ্চিত ধর্মদ্রোহ হবে। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই বছরে ২৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হল। এই আইন পাশের পিছনে গ্রান্ড সাহেবের অবদান ছিল। কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রীশচন্দ্র বাহাদুর, পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির সঙ্গে গ্রান্ড সাহেবের বাংলোয় গিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এলেন।
আইন তো পাশ হল কিন্তু বিধবাদের বিয়ে দিচ্ছে কে? বর্ধমানের শাকনাড়ার বাসিন্দা, বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাই প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ ঈশ্বরকে সাবধান করলেন, ‘‘উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু তোমার অর্থবল কই? এ কাজ ধনবান রাজা লোকদের। আগে টাকার জোগাড় কর, দিশি জমিদারদের নিজের মতে নিয়ে এস, তার পরে না হয় এগিয়ে যেও।’’ বিদ্যাসাগর কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘বিধবার বিয়ে হবে, আমিই দেব।’’
১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। সময় রাতের দ্বিতীয় প্রহর। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে অসংখ্য নিমন্ত্রিতের ভিড়। ৮০০ জনকে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। রাস্তায় গোরা পুলিশের পাহারা। পালকি চেপে পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিয়ে করতে এলেন। তিনি এক সময়ের সংস্কৃত কলেজের আসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এখন মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিত। পাত্রী কালীমতি বর্ধমানের পলাশডাঙার প্রয়াত ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দশ বছরের বিধবা মেয়ে। তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল চার বছর
বয়সে, বিধবা হন ছ’বছর বয়সে। বিদ্যাসাগর বিস্তর খরচ করে প্রথম বিধবা বিবাহের জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ, পণ্ডিত প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ-সহ আরও অনেকের উপস্থিতিতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যাসাগর কনের মা লক্ষ্মীদেবীকে দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করালেন। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে সোনার জলে লেখা থাকল উনিশ শতকের এই তারিখটি।
এই বিয়ে নিয়ে জনসমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। খবরের কাগজে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর ভয়ঙ্কর নিন্দের ঝড় উঠল। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে পক্ষে, বিপক্ষে নানা ধরনের তরজা, গান বাঁধা হল। এমনকি, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল। এ তো গেল ১৬৩ বছর আগের কথা। আজও কেমন আছেন বিধবারা? কথাটি মনে করাতে প্রতি বছর ২৩ জুন ‘আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। বিধবাদের কল্যাণের পিছনে কাজ করাই বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি হবে।
বর্ধমানে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy