একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক ভাবে ভাবার চেষ্টা করছি, ক্লাস টেনে পড়া মাত্র ১৪ বছর বয়সের একটা ফুটফুটে মেয়ে কী করে নিজের জীবনকে শেষ করার মতো এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কী করে সে মনে মনে অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখতে পারে? আর তার এই রকম মনের পরিস্থিতি কি কারও কাছে ধরা পরল না? তা-ই বা কী করে সম্ভব? একটা বইপোকা মেয়ে, মার্শাল আর্ট করা একটা মেয়ে কী ভাবে এত সহজেই নিজের মনোবল ভেঙে ফেলতে পারে?
এক কিশোরী লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন জন্ম দিয়ে গেল। এই প্রশ্নগুলোর যদি উত্তর খোঁজার চেষ্টা আজ না করি, হয়তো আবারও কোনও কিশোরীকে আমরা অকালেই হারাব। আবার, আমাদের একটা মৌনমিছিলে পা মেলাতে হবে কখনও হয়তো। তাই আজ সময় এসেছে কিশোরীর এই চলে যাওয়ার কী কী কারণ থাকতে পারে, তা ঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার।
সংবাদমাধ্যমে মনোবিদদের নিখুঁত বিশ্লেষণ শুনলাম। তাঁরা বললেন, চূড়ান্ত অবসাদ থেকে এই সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছেন। কিন্তু কীসের অবসাদ, তা যদিও বিশ্লেষণ করতে শুনিনি। তাঁরা বললেন, বাড়িতে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের সব সময়ে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান কী ধরনের আচরণ করছেন। যদি কোনও সন্তান অতিরিক্ত রাগ, অভিমান, একা থাকা, কারও উত্তর না দেওয়া, ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপে উত্তর না দিলে বুঝতে হবে তার কোথাও সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা কিশোরীর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট থেকে বললেন প্লাস্টিক জড়িয়ে শ্বাসরোধ করে যে মৃত্যু নিশ্চিত করা যায়, তা কিশোরী জানতো। কিন্তু ডাক্তারবাবুরাও অবাক এবং চিন্তিত কিশোরীর পক্ষে এই ধরনের অভিনব পন্থাকে বেছে নেওয়া কী সম্ভব! একেবারেই বিরল একটা পদ্ধতি কী করে তার মাথায় এল। তাঁরা নিশ্চিত, নেট সার্ফ করে বা কোনও ওয়েব সিরিজ থেকে কিশোরী আত্মহত্যার এই পন্থা বেছে নিয়েছে। অথচ, কিশোরীর কোনও আলাদা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার বা স্মার্টফোন ছিল না। সে স্কুলের কম্পিউটার বা বাড়িতে বাবার ল্যাপটপই ব্যবহার করত। তা হলে কোথা থেকে এই পন্থাকে সে রপ্ত করল, সত্যিই ভাবার বিষয়। আর তার ব্যবহারে কোনও অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ল না, তাই বা কী করে হয়৷
এর আগেও নাকি যখন সে আত্মহননের চিন্তা করেছে— তার মা বলছেন। তা হলে মেয়ের প্রতি তিনি নিশ্চিত বাড়তি নজর রেখেছিলেন আশা করা যায়। অথচ, কিশোরীর চিঠিগুলি প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে চিঠির কিছুটা অংশ সে আগেই লিখে রেখেছিল। আর কিছুটা অংশ মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে লেখা। এর থেকে আন্দাজ করা যায় সে চিঠি বাড়িতেই লিখেছিল। আবার কিশোরী চিঠিতে উল্লেখ করেছে, বাবা-মা যেন তার মৃত্যুর কারণ খুঁজতে চেষ্টা না করে। আবার, কোথাও লেখা সে বাইকে কলকাতা থেকে লন্ডনে যেতে চায়। আবার, কোথাও সে নিজের গুরুত্বহীনতার কথা বলেছে। কোথাও সে লিখেছে— ‘আমায় ভুলে যেও না’। চিঠির কোথাও অসংলগ্ন কথা ঘুরে-ফিরে এসেছে বারবার। অর্থাৎ চিঠি লেখার ধরন দেখে বোঝা যায় তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল অনেকদিন ধরেই। স্কুলে যাওয়ার আগে মাকে কোল্ড ড্রিঙ্কস বা বাবাকে ‘হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি’ আনার কথাতেও তার আচরণ অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। পর পর ৫টি ক্লাস করার পর সিক্সথ পিরিয়ডে সিক রুমে গিয়ে পুরো সময় কাটানোর পর সপ্তম পিরিয়ডে তাঁর খোঁজের মধ্যেই মেয়েটির দেহ মেলে বাথরুম থেকে। সিসিটিভি থেকে পরিষ্কার, কিশোরী একাই বাথরুমে গিয়েছিল।
সমগ্র ঘটনা পরম্পরায় চোখ রাখলে একটা জিনিস পরিষ্কার সে কাউকে কোথাও বুঝতে দেয়নি তার এমন এক কঠিন সিদ্ধান্তের কথা। কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়নি তার আচরণে। আর এটাই বারবার ভাবাচ্ছে। একটা ছোট্ট মেয়ের পক্ষে কী করে সম্ভব এত সুন্দর করে সব দিক সামলে এতটা কঠোর এক সিদ্ধান্ত নেওয়া?
শিক্ষাবিদ সুরঞ্জন দাশ জানালেন— এ এক সামাজিক ব্যাধি। স্কুলগুলোকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলের ব্যাখ্যা, পড়ুয়া অভিভাবকদের নিয়ে স্কুলগুলিকে নিয়ে নিয়মিত কর্মশালা করতে হবে। মনোবিদ সুকন্যা সর্বাধিকারী জানালেন পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ এই অবসাদের কারণ। অভিভাবকদের অতিরিক্ত চাপ অনেক সময় পড়ুয়ারা নিতে পারছে না। তাই তাঁর পরামর্শ, অভিভাবকেরা যেন সন্তানকে ভালবেসে পড়াশোনা করতে বলেন। কোনও চাপ না দিয়েই। গত দু’দিন ধরে এই সব চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিশোরীর এই অবসাদ, তাঁর চিঠি, কারও প্রতি তার ভুলে না যাওয়ার আবেদন, বাইকে করে তাঁর লন্ডন পাড়ি দেওয়ার কথা, বাবা-মার প্রতি তার আবদার, আবার বাবা-মাকে এই মৃত্যুর কারণ খুঁজতে চেষ্টা না করা— এ এক জটিল ও কঠিন প্রশ্ন। কী করে এত নিখুঁত পরিকল্পনা তার পক্ষে সম্ভব। কীসের অভিমান, কীসের অবসাদ, কীসের জন্য কার কাছে তার এই আবেদন? এই সব কথা হয়তো আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার-মনোবিদ-পুলিশ-গোয়েন্দা এর কারণ উদ্ধার করবে। কিন্তু সমগ্র ঘটনার নিরন্তর পর্যালোচনায় কতগুলো প্রশ্ন বারবার সামনে আসছে।
আমরা অভিভাবকেরা কি ছেলেমেয়ের মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বুঝতে চেষ্টা করছি? তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছি? তার একাকিত্ব দূর করার চেষ্টায় তাকে কি যথেষ্ট সময় দিচ্ছি? না কি ছেলে-মেয়ের আবদার মিটিয়েই মনে করছি সব কিছু দিয়ে দিলাম? তার কাছে আমরা ভয়ের হয়ে উঠছি না তো? যে কারণে সে তার প্রকৃত বন্ধুর মতো সব কিছু জানাতে পারছে না। তাই তার খুব কাছে থাকলেও আমরা বাবা-মায়েরাও বুঝে উঠতে পারছি না। বুঝতে চাইছি না মেয়ের বয়স বাড়ছে। তার সঙ্গে এই সময়ে কী রকম ব্যবহার করা উচিত, তার সঙ্গে কোনও কোনও বিষয়ে আলোচনা করা উচিত। আক্ষরিক অর্থে আমরা অভিভাবকেরা তাদের না হতে পেরেছি গাইড, না বন্ধু। বাইরে বাইরে তাদের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেছি, মনের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা কিছুতেই করছি না হয়তো। এর ব্যর্থতা বোধ হয় আমাদেরই। তাদের মতো করে তাদেরকে বুঝতে না চেষ্টা করায় আমরা ব্যর্থ। শুধু অভিভাবক হলেই চলবে না, প্রকৃত অর্থেই তাদের বন্ধু হতে হবে৷ তাদেরকে সময় দিতে হবে, তাদের মনের কথা বুঝতে হবে। তবেই হয়তো কিশোরীদের মতো এমন কুঁড়িকে ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া থেকে আটকানো যাবে।
কলকাতার কিশোরীর এই অঘটনের জন্য কে দায়ী বা কীসের জন্য এই ঘটনা— তা খুব জটিল প্রশ্ন৷ কারণ অবশ্যই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু তার আগে নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব এড়াতে পারি না।
লেখক এসআরএফ কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy