অপেক্ষার শূন্য দৃষ্টি। সিউড়িতে। মঙ্গলবার। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
পার্বতী লোহার। বয়স ৭৭ । সেই কোন যুগে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে বাবুদের বাড়ির ধান সিদ্ধ করে, মুড়ি ভেজে ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটাও কলমিস্ত্রির কাজ করে ভালই দু’পয়সা রোজগার করছিল। এখন কাজ বন্ধ। কী হবে এখন? শরীরে তো আর তেমন জোর নেই। শুনেছেন বার্ধক্য ভাতার খাতাতেও তাঁর নাম ওঠেনি। কেন? জানেন না পার্বতী। শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু ভাবেন, এভাবে আর কতদিন?
বাসন্তী মালো। বয়স ৬২। স্বামী পঙ্গু। ছেলে কাজ করে মুম্বইয়ে। বাবুদের বাড়ি থেকে বাসন্তীকে বলেছে কাজে না গেলে মাইনে কাটবে। রাতে ঘুম আসে না তাঁরও। ছেলেটা কবে ফিরবে কে জানে? আর কতদিন?
সোমশুভ্র বন্দোপাধ্যায়। বয়স ৬৫। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। গতবছর স্ত্রীকে হারিয়েছেন। একমাত্র ছেলে কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে থাকে। এখন ভরসা বলতে শুধুই রান্নার মেয়ে আর কাজের লোক। সংক্রমণের ভয়ে তাদেরও ছুটি দিয়েছেন। খবর দেখলে বুক কেঁপে ওঠে। শুধুই মৃত্যু মিছিল। ভাবেন, এর শেষ কোথায়? ভাবেন, আর কতদিন?
ঋতা বসু। বয়স সবে ৬০ পেরিয়েছে। অবিবাহিতা। মায়ের সঙ্গে থাকেন এক কামরার ফ্ল্যাটে। নব্বই বছরের মাকে দেখাশোনার দায়িত্ব এখন তাঁর ওপর। এখন যে লকডাউন। সুগার, প্রেসার, বাতের ব্যাথায় জর্জরিত ঋতা রাতে অজানা আশংকায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। এই নির্বান্ধব পরিবেশে আর কতদিন?
উপরের নামগুলো কল্পিত হলেও এঁরা কেউই আমাদের অপরিচিত নয়। করোনা নামক এই অতিমারির প্রভাবে সমস্ত বয়স্ক নাগরিকরা আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক ইত্যাদি বহুমাত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সমগ্র বিশ্বে ষাটোর্ধ্ব নাগরিকরা জনসংখ্যার দ্রুত বর্ধনশীল অংশ। ভারতের প্রবীণ জনসংখ্যার পরিমাণ বহু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। ভারতের প্রবীণদের কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করেন । তাঁরা নিরক্ষর এবং অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। কালের নিয়মেই তাঁদের উপার্জনক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাঁদের অনেকেই পর্যাপ্ত সঞ্চয় না থাকায় দৈনন্দিন গ্রাসাচ্ছাদন, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদাগুলির ক্ষেত্রেও চরম দুর্ভোগের শিকার হন। যাঁরা সমাজের তথাকথিত ক্রিমি লেয়ার তাঁদের সমস্যা আবার অন্যরকম। ষাট ছুঁইছুঁই হতেই মনে গুনগুনিয়ে ওঠে কবীর সুমন – ‘‘বয়স হচ্ছে বলেই বোধহয় মাঝে মাঝে একলা লাগে।’’ শারীরিক অবনতি, মানসিক স্থিতিশীলতা হ্রাস কখনও বা প্রিয়জন বিয়োগ, বর্তমান নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির নতুন ধারায় সন্তান- নাতি-নাতনীর সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে তাঁরা বড় নিঃসঙ্গ । এমতাবস্থায় কোভিড-১৯ হল গোদের ওপর বিষফোঁড়া। নোভেল করোনা ভাইরাস সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রবীন নাগরিকদের বেঁচে থাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই জীবানু দ্বারা সংক্রামিত হয়ে মৃত্যুর হার যেমন বয়স্কদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি তেমনই ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ঘরবন্দি অবস্থায়, দুশ্চিন্তা আর মৃত্যুভয়ে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা বোধহয় আরও বিপজ্জনক। মর্নিংওয়াক বন্ধ, পাড়ায় কাকিমা-জ্যেঠিমাদের লুডোর ঠেক বন্ধ, এমনকি বয়স্ক মহিলাদের প্রিয় গসিপিং এর জায়গা মন্দিরগুলোও আজ শূন্য । প্রবীণদের অনেকেই স্মার্ট ফোনের ব্যবহার এখন ও তেমন রপ্ত করতে পারেননি। ফলে তাঁদের নিজস্ব বন্ধুমহল থেকে তাঁরা দূরে সরে গিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে নিঃসঙ্গতা মানসিক উদ্বেগ এবং হতাশা বাড়ায়। সামাজিক দূরত্বের এই নতুন অনুশীলনের ফলে বাড়বে হৃদরোগের সম্ভাবনা, ডিমেনশিয়ার প্রকোপ এবং অন্যান্য স্নায়বিক ব্যাধি । আবার পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্টতঃ বোঝা যায় যে এই লকডাউন কঠোরভাবে না মানলে প্রবীণরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন। তাহলে উপায়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর পক্ষ থেকে ড: হান্স ক্লুজ এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন, “I am reminding governments and authorities that all communities must be supported to deliver interventions to ensure older people have what they need. All older people should be treated with respect and dignity during these times.
"সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি ডাকবিভাগের কর্মীরা অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের পেনশন পৌঁছে দিচ্ছেন। এভাবে অনেকেই এগিয়ে আসছেন, বাড়িয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মত প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরিসরে এই ছোট ছোট উদ্যোগ প্রবীণদের বিবর্ণ, রংচটা জীবনে এক ঝলক খুশির হাওয়া বয়ে নিয়ে আসবে বলেই আশা করা যায়। আমরা আরও আশা করব, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভাল থাকার জন্য সরকারি স্তরে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রবীণ শ্রমিকরা পুষ্টিকর খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধ, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রভৃতি কোনওকিছু থেকেই যেন বঞ্চিত না হন তা অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এই বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব যাতে সমস্ত বয়স্ক নাগরিকদের বিষাদে নুব্জ্য করতে না পারে আশাকর্মীদের মাধ্যমে তাঁদের মনোবল বাড়ানোর ভার নিতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব অভ্যাস করতে হবে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের সেই ‘লালু’কে মনে পড়ে? পাড়ার ক্লাবগুলোতে ওই লালুর মতো অকুতোভয়, পরোপকারী ছেলেরা আজ বিরল। সমাজের অসহায়, ব্রাত্য মানুষদের বিপদে আপদে ছুটে যাওয়া সেই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র রেওয়াজ লুপ্তপ্রায়। কে বলতে পারে এই দুঃসময়, এই অতিমারি হয়তো আমাদের অনেক ভাল কিছুও ফিরিয়ে দেবে। নতুন বছরের শুরুতে তাই আঁধার পেরিয়ে এক সূর্যমুখী ভোরের অপেক্ষায় আশায় বুক বাঁধি আমরা। আলোর হদিশ দিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ কবি সাদাত হোসাইন, বলেছেন,
‘একদিন, আসবে সুদিন / জানবে মানুষ তার রয়ে গেছে ঋণ / রয়ে গেছে বুকভার অথৈ অসুখ / মৃত্যু পেরিয়ে তবু জীবন আসুক’।
লেখক বীরভূম জেলা জজ্ আদালতের কর্মী, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy