বিপদে মানুষ অন্যের পাশে দাঁড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর করোনা-কালের মতো বিপদ কেউই দেখেননি। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এই জনবহুল দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ হলে, একজোট হয়ে লড়তে হবে। সরকার তার করণীয় করবে। সঙ্গে আমরাও কী করতে পারি— ভাবা দরকার। এক জনও সংক্রমিত থাকলে, রয়ে যাবে সংক্রমণের আশঙ্কা। করোনা দেখিয়েছে, রোগভোগ নিজস্ব হলেও গোটা সমাজই তার ভাগীদার।
জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ভিন্ন জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে। সমাজভুক্ত মানুষজনের পক্ষেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা সম্ভব। ১৮৯৮-এর প্লেগ-মহামারির সময় ঠাকুরবাড়ির সদস্যেরা চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আর সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইনস্পেকশনে যেতেন, নিবেদিতা বিলি করতেন হ্যান্ডবিল। প্লেগ নিয়ে তত্ত্বকথায় বিরক্ত বিবেকানন্দ কাজের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের পরিচয় রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্লেগ নিবারণে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সভ্যদের সঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন তিনি।
বিপর্যয়ে বা আনন্দলগ্নে— বাঙালির ইতিহাসে ঘুরে ফিরে আসে এমন সমবেত প্রয়াসের ছবি। আর এখানেই পাড়া বা পাড়ার ক্লাবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদরা পাড়ার সামাজিক কাঠামো এবং গঠন বিন্যাস নিয়ে বহু আলোচনা করেছেন। বাঙালির জীবনযাপনে পাড়া শুধুই ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। পাশাপাশি কয়েকটি বাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লেই পাড়া হয় না। একে অন্যের সুখে-দুঃখে ছুটে যাওয়া, এ বাড়ি ও বাড়ির গল্প-ঝগড়া, রটনা-ঘটনা— এই নিয়েই তৈরি হয়েছে পাড়া। সেখানে ছেলেমেয়েরা বৃহত্তর পরিবারের সন্তানসন্ততি। তাদের উপরে প্রতিবেশী কাকু-জেঠু, মাসিমা-পিসিমাদের কড়া শাসন এবং প্রশ্রয়ের পরশ। বাড়ির ঠিকানার ভৌগোলিক পরিধিকে ছাপিয়ে পাড়া যেন নিশ্চিত আশ্রয়, সামাজিকতার আধার। এই মিলেমিশে বেঁচে থাকা দৃঢ়তর হয় ক্লাবের কর্মকাণ্ডে।
কলকাতায় ‘ক্লাব কালচার’-এর আবির্ভাব বিশ শতকের গোড়ায়। উদ্দেশ্য ছিল শরীরচর্চা, যাত্রা, থিয়েটার, গান-বাজনা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পাড়ার বাসিন্দাদের এক সূত্রে বেঁধে রাখা। পাড়ার ছেলেরা সবেতেই যোগ দিত। শরীর চর্চার সঙ্গেই চলত চরিত্র গঠন। পাড়ার মাঠ পরিষ্কার করা হত, লাইব্রেরিও বানানো হত। স্বদেশি আন্দোলনের সময় উত্তর কলকাতার আহিরীটোলা, হেদুয়া, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, বাগবাজার প্রভৃতি এলাকার অনেক ক্লাব সশস্ত্র বিপ্লবীদের হয়ে গোপনে কাজ করত। আবার শিশু ও মহিলাদের জন্য পাড়ার দ্বারে দ্বারে ঘুরে চাল ডাল সংগ্রহ করত। এ ভাবেই পাড়ার মধ্যে চলত বৃহত্তর সমাজের গঠনমূলক কর্মযজ্ঞ।
‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র প্রতিষ্ঠাতা অতীন বসু ও অমর বসুর তত্ত্বাবধানে সভ্যরা এলাকায় বন্যার ত্রাণ সংগ্রহে নামতেন। দাঙ্গাহাঙ্গামা হলে পাড়া রক্ষায় এগিয়ে আসতেন। পাড়া আর ক্লাবের পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক প্রকৃত অর্থে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন বিপর্যয়ে। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে শত শত মানুষ ভিটেমাটি ফেলে কলকাতার পথে ভিড় করেছিলেন। নিরন্নদের মুখে অন্ন জোগাতে এলগিন রোড, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর-সহ দক্ষিণ কলকাতার অনেক পাড়াতেই বেসরকারি উদ্যোগে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। নানাবতী কমিশনের রিপোর্টে জানা যায় ১৯৪৩-এ কসবায় রাতারাতি তৈরি হয় ‘বোসপুকুর রিলিফ কমিটি’। সংগঠনটি বালিগঞ্জ এবং ঢাকুরিয়ায় আগত দুর্গতদের জন্য কসবা-বালিগঞ্জের পাড়ায় ঘুরে ত্রাণ তুলত। হিসাব অনুযায়ী ১৯৪৩-এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৪-এর জানুয়ারি অবধি ১,৯৬,৬৭২ জনকে সাহায্য করেছিল।
অর্থাৎ আমাদের ইতিহাস, আমাদের পারিপার্শ্বিকেই সমবেত বাঁচার রসদ লুকিয়ে। পুজো, ইদ, বড়দিন, রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা, বসে আঁকো, রক্তদান— বারো মাসে তেরো পার্বণে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকে পাড়া এবং ক্লাব। বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। রাজনৈতিক সমীকরণের ভাঙাগড়াতেও পরোক্ষ ভূমিকা নিয়েছে। ‘অনুশীলন সমিতি’ থেকে চিত্তরঞ্জন-সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস, বামপন্থী আন্দোলন থেকে হালে তৃণমূলের অনুদানের রাজনীতি— ক্লাবগুলি অনেক ভারই সামলেছে। কান পাতলে শোনা যাবে— ক্লাব যার, ভোট তার। নানা এলাকার ক্লাবঘর রাজনৈতিক ‘দাদা’দের উত্থানের কারিগর, পতনের সাক্ষী। অমুক দাদার ক্লাব, তমুক দাদার পাড়া হয়ে উঠেছে বঙ্গজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আজ শহরের বিভিন্ন এলাকা, পাড়া কনটেনমেন্ট জ়োন-এ পরিণত। বয়স্ক, অসুস্থ বা দুঃস্থদের খেয়াল রাখা, একজোট হয়ে সাহায্যের হাত বাড়ানো, ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ— সবেতেই এখন পাড়া আর ক্লাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। মৃদু উপসর্গের আক্রান্তের জন্য পাড়াতেই প্রাতিষ্ঠানিক নিভৃতবাস পরিচালনা করতে পারেন ক্লাবসদস্যেরা। শহরাঞ্চলে আশাকর্মীদের অপ্রতুলতায় করোনা-নজরদারির দুর্বলতা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন এক স্বাস্থ্যকর্তা। প্রশাসনের সহায়তায় প্রশিক্ষণ দিয়ে পাড়াতেই স্বেচ্ছাসেবক দল গড়া যায়।
করার আছে অনেক, করার মানুষও অনেক। তবে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগগুলিকে সমাজের, সামাজিকতার অন্তরে প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। ‘সামাজিক দূরত্ব’-ই আজ বাঁচার মন্ত্র। এ সময় গোষ্ঠীগত উদ্যোগ সুস্থ সমাজের দিকনির্দেশ দিতে পারে। যথাযথ অর্থে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার মধ্য দিয়েই হয়তো করোনা-র বন্ধনমুক্তি সম্ভব।
ঋণস্বীকার: সায়ন দাস
ইতিহাস এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগ, জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy