ইংরেজি ১৯৪২ সাল, এক দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, অন্য দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের জনমত তাদের দিকে ফেরানোর জন্য তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্টাফর্ড ক্রিপসের মতো প্রতিনিধিকে এক টুকরো ‘CARROT’-এর প্রস্তাব দিয়ে ব্রিটেন থেকে ভারতে পাঠিয়েছিল। ক্রিপস মিশনের ‘ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস’-এর প্রস্তাব বনাম ভারতীয়দের ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর দাবিতে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি গাঁধীজির নেতৃত্বে ৮ অগস্ট ১৯৪২ দেশ জুড়ে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ইংরেজ বাহিনী ও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াইয়ে ইংরেজ দ্বারা দশ হাজারের বেশি স্বাধীনতা সংগ্রামী মারা যাওয়ায় প্রতিবাদে গাঁধীজি সরকারে বিরুদ্ধে অনশনে বসলেন।
অন্য দিকে, ব্রিটেনের প্রতিপক্ষ জাপান তার সেনাদের নিয়ে বর্মা অবধি তাদের আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে। সুভাষচন্দ্র বোস তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে ও জাপানিদের সাহায্যে ভারতের ইম্ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
এই দুই অবস্থার মধ্যবর্তীতে ১৯৪৩ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া নেমে এল। ইতিহাসে যাকে আমরা বলি— তেতাল্লিশের মন্নন্তর। এক দিকে ব্রিটেনের যুদ্ধ সেনাদের খাবারের রসদ জোগান, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের খাবারের রসদ জোগান দেওয়া, অন্য দিকে বর্মা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়া। যে পরিমাণ অবশিষ্ট খাবার মজুত ছিল তার ভুল বণ্টন ও কিছু মুনাফালোভীদের জন্য বাকি অংশটুকুও চলে গেল এক দল কালোবাজারির দখলে।
এ দিকে ব্রিটিশ সরকারও নির্বিকার। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমনিতেই সারা দেশ জুড়ে হাহাকার চলছে তখন। প্রাণের লড়াই চলছে। তার মধ্যে বাংলায় শুরু হল সেই ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। মজুতদার, আড়তদার, সুদখোর, ধনীদের কাছে মজুত ছিল প্রচুর খাদ্য রসদ। অথচ, গরিব, নিপীড়িত, সর্বহারা মানুষের একমুঠো খাবারের জন্য চিৎকারের সেই ইতিহাস আজও কাঁদিয়ে তোলে। হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরের দিকে চলেছে শুধু একমুঠো খাবারের আশায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফ্যান’ কবিতা, তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’, সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘একটি মোরগের কাহিনী’ সেই দুর্ভিক্ষের জ্বলজ্যান্ত ছবি তুলে ধরেছে।
সে সময়ে রাস্তার এ দিকে ও দিকে মানুষ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষের দেহ কঙ্কালে পরিণত হয়েছে, আস্তাকুঁড়ে থেকেও মানুষ খাবার কুড়িয়ে খাবার জন্য কুকুর-বিড়ালের মতো লড়ে গিয়েছে।
বৃদ্ধ, মহিলা, জোয়ান, শিশুর মৃতদেহ রাস্তায় রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষ মারা গিয়েছিল শুধু মাত্র এক মুঠো খাদ্যের অভাবে। ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ বেঁচে ছিল শুধু কঙ্কালের উপর চামড়া জড়িয়ে। তখন ভারতের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৩ কোটি।
বর্তমান পরিস্থিতিও সেই সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যময়। সমগ্র দেশ তথা পৃথিবী জুড়ে মানুষ যখন গৃহবন্দি, চারদিকে লকডাউন ও পারস্পরিক দূরত্বের দামামা বেজে চলেছে। সংবাদমাধ্যম, সংবাদপত্র, হোর্ডিং, প্রচার-গাড়ি সর্বত্র হুঁশিয়ারি বার্তা জানানো হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিয়মিত জানিয়ে চলেছে পৃথিবী জুড়ে সংক্রমিত, মৃত ও সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা মানুষগুলোর দৈনিক গণনা। আমরা এতেই ক্লান্ত, ত্রস্ত-বিধ্বস্ত। তবে আমরা ভুলে যাচ্ছি, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী বৃহৎ সমস্যাগুলির অধিকাংশই জনজীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা যাবে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর।
আমাদের দেশের সমগ্র জনসংখ্যার ৫.৫% মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার আশপাশে অবস্থিত। তাঁদের কাছে দৈনিক জীবনযাপন করার মতো ন্যূনতম রসদটুকু নেই। জোগাড় করার আর্থিক বা সামাজিক ক্ষমতাও প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাতে বেঁচে গেলেও এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ বাঁচাতে আমাদের দেশের, রাজ্যের তথা বিশ্বের নিয়ন্ত্রারা প্রস্তুত তো?
যে সমস্ত মানুষ ভিন্ রাজ্যে তথা বিদেশে কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন, মহামারির প্রকোপে তঁাদের বড় অংশ আজ বাড়িতে ফিরে এসেছে। শিক্ষা, পরিবহণ, শিল্প— সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ। শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে বেকারত্বের ভীতি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দিনমজুরদের পর দিনের বেঁচে থাকার চিন্তা, ক্রমশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, চুরি, ডাকাতি, শোষণ, উৎপীড়নের লক্ষণ রোগের উপসর্গের মতো একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছে।
দ্বিতীয় দফায় লকডাউন শেষ হলে ৪ মে থেকে ১৭ মে ফের শুরু হবে তৃতীয় দফার লকডাউন। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের হাতে যে পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত ছিল, সেটা এই ক’দিনের লকডাউনে শেষের মুখে গিয়ে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। দেশের জিডিপি যে ভাবে নিম্নমুখী, আর বেশি দিন এমন অবস্থা চললে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ফেরাতে আরও কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
এক দিকে আমাদের দেশের দশ শতাংশ মানুষ সমগ্র দেশের অর্থের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ভোগ করেছে। অন্য দিকে, একটা বড় অংশের মানুষ তাঁদের পরিবারের মানুষের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিগত পঁচিশ বছর ধরে ধনী, গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য মেটানোর যে চেষ্টা চলছে, করোনার জেরে লকডাউনের পরবর্তী সময়ে সেই বৈষম্য আবার প্রকট হতে দেখা যাবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্য দিকে, দিনে দিনে দেশে যে হারে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে না এই লকডাউন আর কত দিন চলতে পারে।
গোটা বিশ্ব লড়ছে এক মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে। প্রতিষেধক, ওষুধ, চিকিৎসা পদ্ধতি— এ সব যত দিন না আবিষ্কার হচ্ছে, গোটা বিশ্ব পারস্পরিক দূরত্বের প্রতিষেধক নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। রোগ যাতে আর না ছড়ায়, যেন গোষ্ঠী সংক্রমণ রোখা যায়, সে জন্য বাধ্য হয়ে লকডাউনে ভরসা রাখা হচ্ছে। কিন্তু তার আড়ালে কত কত মানুষের দৈনিক রোজগার থমকে গিয়েছে, কত অর্থনৈতিক মন্দার অশনিসঙ্কেত জন্ম নিচ্ছে রোজ রোজ, আমরা ভাবতেও পারছি না। তবু আমরা লড়ছি। আমাদের লড়াইটা একটু হলেও আলাদা। আমাদের প্রগতিশীল, জনবহুল দেশ। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি সমস্ত ধর্মের মানুষের বাস এই দেশে। পারস্পরিক মেলবন্ধন ও সামাজিক জোটবদ্ধতা আমাদের একমাত্র বল। দেশ জুড়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। গরিব-সর্বহারা মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। আমাদের সকলেরই উচিত এমন অবস্থায় একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়ানো। নয়তো তেতাল্লিশের মন্নন্তরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে সময় লাগবে না! আর এ বার দুর্ভিক্ষ হলে শুধু বাংলায় না, সমগ্র দেশ জুড়ে এর প্রকোপ দেখা যাবে।
আরও একবার মানুষ খিদের জ্বালায় রাস্তায় বেরিয়ে শুধু একটু ফ্যান চাওয়ার আগে আমরা দুই হাতে আঁকড়ে ধরি আমাদের পৃথিবীকে। শুশ্রুষা করি আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর। পৃথিবীটা তো শুধু আমাদের একার নয়, সব মানুষের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy