শেক্সপিয়ারের অমোঘ উচ্চারণ: life is but a walking shadow...। জীবনটা একটা চলমান ছায়া বই আর কিছু নয়। সত্যিই তো তাই। জীবন তো এক সাময়িক বসবাস। চলে যাওয়াটাই অনিবার্য সত্য। তা-ই যদি হয় তবে যে ক’দিনের জন্য জীবনকে যাপন করতে আসা, সেই দিনগুলি অনন্যতায় ভরিয়ে দিই না কেন? কেন মনে রাখি না সেই পঙ্ক্তি ক’টি: ‘এই মুহূর্তে আছি আবার এই মুহূর্তে নাই / এই মুহূর্তে রক্ত মাংস এই মুহূর্তে ছাই/ তবু এত ঝগড়া-বিবাদ, মিথ্যার রোশনাই?’
এ জীবন মহার্ঘ। অথচ তা কাটিয়ে দিচ্ছি কী অদ্ভুত ঔদাসীন্যে! সম্পদ ছড়িয়ে আছে জীবনের চারদিকে। অথচ চিনতে পারি না। তাকিয়েও দেখি না। সম্প্রতি কয়েকদিন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় এ যেন আরও বেশি স্পষ্ট ও প্রকট হয়ে উঠল। নিজেকে মনে হচ্ছিল কর্মহীন, নিঃসম্বল, বেঁচে থাকার রসদবিহীন এক অদ্ভুত ভারবাহী অস্তিত্ব।
ঘুমে তাই অচেতন হয়েছিলাম। হঠাৎ ওরা আমার ঘুম ভাঙাল। ওরা, মানে আমার বন্ধুরা। ওরা বলল, ‘‘ উঠে দেখ, জগৎটা কী অপরূপ! আনন্দ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আখরিগঞ্জে পদ্মাপারে তানসেন গাইছেন ঘুম ভাঙানিয়া গান। সুরের সুরায় নেশাতুর পাশাপাশি বসে আছেন আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানি। হাসনুহানার গন্ধে ভিজে আছে বাতাস। ঘ্রাণ নাও প্রাণভরে। ভোর হয়েছে ভেবে কলকাকলি শুরু করেছে পাখিরা। শোনো কান পেতে।’’
ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলাম। দেখি, সভ্যতার বিচিত্র পথে মানবজাতি চলেছে যুগ থেকে যুগান্তরের দিকে। জীবনের উচ্ছ্বাসে স্পন্দিত সৃষ্টির সব সত্তা। চারদিকে এত হাসি, এত গান, এত রূপ, এত রং, এত গন্ধ, এত প্রেমে আমি বিহ্বল। আমার সেই বন্ধুরা বলল, ‘‘জীবনের স্বাদ চেটেপুটে নাও বন্ধু। জীবনকে যাপন করতে শেখো। গায়ে মাখো সাগরের লোনা হাওয়া। কথা বলো ফুলেদের সাথে, পাখিদের সাথে। পাহাড়কে জড়িয়ে ধরো। হাঁটো বৃষ্টি ভেজা পথে আর মিলে যাও অরণ্যের সবুজতায়।’’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওদের দিকে। ওরা বলল, ‘‘জীবনের গান শোনো বন্ধু। বাঁচতে ভালবাসো আর ভালবেসে বাঁচো। একাকিত্বের পরম বেদনা থেকে মুক্তি নিয়ে চলো তৃপ্তির অমৃত সাগরের পাড়ে।’’ সম্বিৎ ফেরে আমার। এক দিন যেতে হবে সব কিছু ছেড়ে— অনস্তিত্বের এই বোধের সঙ্গে মিশে যায় চিরন্তন অস্তিত্বের ধারণা। নিজেকে চিনতে পারি অন্তহীন কালসমুদ্রের যাত্রী বলে। বুকের মধ্যে বাজে, ‘‘নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ।’’ ওরা যেন বলে, ‘‘তুমি পূর্ণ, তুমিই সৃষ্টির প্রথম বার্তাবাহক। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে পূর্ণই অবশেষ।’’
ওরা শোনালো আমাকে এই পরম সত্যের কথা। জীবনের জয়গান গেয়ে আমাকে ঋদ্ধ করল, তৃপ্ত করল, অনির্বাণ করে তুলল। আমাকে শেখালো ওরা, সত্যি করে বাঁচার আনন্দ কাকে বলে আর কোথায় পাব তারে। চারদিকে জীবনের সফেন সমুদ্রের মধ্যে ওরা আমাকে দিল এক অনন্ত অনুভব, এক অনির্বচনীয় শান্ততা।
হয়তো মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কারা এই বন্ধুরা, কোথায় থাকে তারা? ওরা আর কেউ নয়, প্রাণের ভিতরে থাকা আমার বোধ, অনুভব। বাইরের দুর্বিষহ ভোগ কিংবা দুর্ভোগ থেকে সরে এসে মনোরাজ্যের অতলান্তিকে বুঁদ হতে পারলেই ওদের সন্ধান পাওয়া যায়।
পরিশেষে শোনাই স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের একটি ঘটনার কথা। পরিব্রাজক হিসেবে যখন তিনি পশ্চিম ভারতে, সেই সময়ে এক সন্ধ্যায় তিনি উপস্থিত হলেন মহাবালেশ্বরে। আলাপ হল এক উকিলের সঙ্গে। বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ সেই উকিলের একান্ত অনুরোধে সেই রাতটা তাঁর বাড়িতে অবস্থান করবেন বলে স্থির করলেন তিনি। স্বামীজি পৌঁছলেন তাঁর বাড়িতে।
কিন্তু মহা বিপত্তি বাধল রাতে ঘুমের সময়ে। ভদ্রলোকের একটি শিশুকন্যা ছিল। একেবারে কোলের শিশু। সেই রাতে হঠাৎ চিৎকার জুড়ে দিয়েছে সে, একেবারে চিল চিৎকার। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন দম্পতি সে কান্না থামাতে। কিন্তু কিসের কী! পাশের ঘরে বসে থাকা স্বামীজি বুঝলেন, ঘুমের আজ দফারফা। হঠাৎ সেই কন্যার জননীকে স্বামীজি বললেন, কন্যাটিকে তাঁর কোলে শুইয়ে দিতে। সেই মতোই কাজ করলেন উকিলজায়া। স্বামীজির সেই অপরিচিত কোলে শুয়ে বাচ্চা যেন দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে শুরু করল। তাকে কোলে শুইয়ে রেখে স্বামীজি এ বার ডুবে গেলেন ধ্যানের গভীরে। মন্ত্রের মতো কাজ হল হঠাৎ। বাচ্চাটি ধীরে ধীরে কান্না থামিয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল ধ্যানমগ্ন স্বামীজির মুখের দিকে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।
একান্ত বাস্তব এই গল্পটি যেন এক অনন্য প্রতীক। ওই শিশু তো আমরাই। চিৎকার করে কেঁদে চলেছি ‘আরও দাও, আরও দাও’ বলে। অস্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ঈর্ষায় জর্জরিত, অন্ধ আমরা হত্যা করছি আমাদের বোধ নামক বন্ধুদের। নিজেদের সৃষ্ট অশান্তির আগুনে দগ্ধ হতে হতে আমরা বাঁচতে ভুলে যাচ্ছি।
একমাত্র উপায় বাহ্যিকতার দানবীয় আগুন থেকে সরে এসে অন্তরের অর্ণবে ডুব দেওয়া। সেখানেই খুঁজে পাব আমাদের বন্ধুদের, যারা আমাদের সত্যি করে বাঁচতে শেখাবে। জীবন জুড়ে শুধু তখন আনন্দ, আনন্দ, পরমানন্দ। যে আনন্দ পেতে কোনও উপকরণের প্রয়োজন হয় না।
শিক্ষক, সারগাছি রামকৃষ্ণ
মিশন উচ্চ বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy