গোপনচারী: নাৎসি অত্যাচারের প্রতিবাদে বার্লিন শহরে নির্মিত সমকামী স্মারক-স্তম্ভ। গেটি ইমেজেস
কয়েক দিন আগে সমাজবিজ্ঞানের গবেষক এক বন্ধু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ‘ভার্চুয়াল’ জগৎ কী ভাবে কিছু ‘ইমেজ’-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। একের পর এক ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবলই সেই ইমেজের বদল ঘটতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজ-বিচ্ছিন্ন ভাবেই তা ঘটে চলে।
সমকামিতা নিয়ে শীর্ষ আদালতের ‘যুগান্তকারী’ রায় ঘোষণার পর ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপে ভরে যাওয়া তেমনই কিছু ইমেজ মানসিক শান্তি জোগাচ্ছে। বন্ধুরা প্রোফাইল ছবি রাঙিয়ে দিচ্ছেন রামধনু রঙে। সমকামিতার রং হিসেবে যে রামধনু, শিক্ষিত ভার্চুয়াল সমাজ তাকে লড়াইয়ের নিশান হিসেবে চিনে নিয়েছে। শিক্ষকসমান এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘‘৬ সেপ্টেম্বর, সত্যিই একটি রেড-লেটার দিন, না কি, রামধনু রঙের দিন!’’ আর এক বন্ধু আমির খসরুর ‘ছাপ তিলক’ উদ্ধৃত করে দেখাতে চেয়েছেন, সেই কবে থেকে লিঙ্গ-ভাবনার ‘স্টিরিয়োটাইপ’ ভেঙেছে ভারতীয় সংস্কৃতি।
জার্মানি
বরফ-জমা বার্লিনেও এমনই কিছু ইতিহাস মনে-রাখা ইমেজ দেখার সুযোগ ঘটেছিল গেল ডিসেম্বরে। এক দিকে বিশাল মাঠের উপর থরে থরে সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে তৈরি ‘হলোকস্ট মেমোরিয়াল’। ইহুদি না হলেও, নানা উচ্চতার সেই স্ল্যাবের গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেই মেমোরিয়ালের অনতিদূরে অন্ধকার, নির্জন পার্ক। হিমাঙ্ক ঠান্ডায় আলোহীন সেই পার্ক খানিক ভূতুড়েই। চোখ সয়ে এলে দেখা যায়, গাছগাছালির আড়ালে কংক্রিটের এক মস্ত স্তম্ভ। সামনের বোর্ডে আলো ফেললে বোঝা যায়, আরও একটি মেমোরিয়াল। নাৎসি জার্মানি সমকামীদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল, তার প্রতিবাদে হোমোসেক্সুয়াল মেমোরিয়াল।
ইটভাটার চিমনির মতো দেখতে ‘কুৎসিত’ সেই স্তম্ভের কাছে পৌঁছলে চোখে পড়ে, দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট প্রকোষ্ঠ। কালো-সাদা আলোর বিম। প্রিজ়মের মতো ঢুকে যাওয়া চৌখুপিতে ঘুরেই চলেছে সমকামীদের নিয়ে তৈরি ফিল্ম। চরিত্রেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন বার্লিনের পরিচিত রাস্তাঘাটে। চুমু খাচ্ছেন একে অপরকে। আর আশপাশের মানুষ আড়চোখে দেখছেন তাঁদের। চাহনিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ‘ওরা-আমরা’র তফাত।
ভারত
‘ওঁদের’ আর ‘আমাদের’ সামাজিক ও যৌন জীবনের চাহিদাগুলো যে একই রকম, শীর্ষ আদালতের রায়ে সেটাই স্পষ্ট করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি জানিয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক দুই সমকামী পরস্পরের সম্মতিতে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারেন, এটা কোনও ‘অপরাধ’ নয়। দেশের রামধনু আন্দোলনে যা এক ঐতিহাসিক জয়। সকলেই কুর্নিশ জানাচ্ছেন দেশের বিচারব্যবস্থাকে। কিন্তু আন্দোলনের সামাজিক মুক্তি ঘটল কি?
এ প্রসঙ্গে অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে ৩৭৭ নম্বর ধারার ১৫৮ বছরের ইতিহাস। দরকার সেই সব আলোচনার, যেখানে চর্চা হবে, ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রায় প্রতিটি দেশেই পেনাল কোডে ৩৭৭ ধারার অবস্থান। উল্লেখ্য, কিছু দিন আগে এই ধারা নিয়ে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর আদালতে সওয়াল জবাব হয়েছিল। সেখানকার বিচারপতি রায়-দানের সময় উল্লেখ করেছিলেন ভারতীয় শীর্ষ আদালতের মৌলিক অধিকার বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ। আবার ত্রিনিদাদ ও টোবাগো আদালতের ৩৭৭ নম্বর ধারা বিষয়ক পর্যবেক্ষণটি এ বার উত্থাপিত হল সুপ্রিম কোর্টের সওয়াল-জবাব পর্বে।
ব্রিটিশ গিয়েছে। বিলেতের আইন বদলেছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে অধিকাংশ উপনিবেশ শুধু ঔপনিবেশিক আইনকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকেনি, তার পক্ষে সওয়ালও করে গিয়েছে লাগাতার। এমনকি একুশ শতকেও। রামধনু আন্দোলনকারীরা আদালতের রায়কে তাই শাপমুক্তি হিসেবেই দেখছেন। যদিও ২০১৩ সালে কিন্তু এই আদালতই ৩৭৭ ধারার পক্ষে সওয়াল করেছিল। সাম্প্রতিক রায়ে শীর্ষ আদালত সেই রায় সম্পর্কেও ‘ক্ষুব্ধ’ পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে।
তবে এর পরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ইমেজের প্রশ্ন। আদালত যা পারে, জনপ্রতিনিধিরা তা পারেন না কেন? লাগাতার বেশ কিছু বছর ধরে বার বার ৩৭৭ নম্বর ধারা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব উঠেছে দেশের সংসদে। দু’বার প্রাইভেট মেম্বার্স বিল এনে বিষয়টিকে আলোচনার কেন্দ্রে আনতে চেয়েছেন সাংসদ শশী তারুর। দ্বিতীয় বার তাঁর বিলের পক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র ১৪টি। এই বছরের গোড়ায় শীতকালীন অধিবেশনেও তারুর চেষ্টা করেছিলেন সমকামী অধিকারের বিষয়গুলি আলোচনায় আনতে। বিষয়টি বিতর্কেই তুলতে পারেননি তিনি। দেশের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে তাঁকে শুনতে হয়েছিল, বিষয়টি ‘বিতর্কিত’। প্রতি বারই নিজের ক্ষোভ সোশ্যাল মিডিয়ায় উগরে দিয়েছেন সাংসদ তারুর।
বছরভর বহু বিতর্কিত বিষয়ে রাজনীতির কারবারিরা লাগাতার ‘নির্লজ্জ’ তুতুমৈঁমৈঁ চালিয়ে যেতে পারলেও সমকামিতার মতো একটি ‘লজ্জাকর’ বিষয়ে যে তাঁরা আলাপ করতে পারেন না, ইতিমধ্যেই তা প্রমাণিত। মনে রাখা ভাল, সংসদীয় গণতন্ত্রে এই সমস্ত রাজনীতিক ‘জনপ্রতিনিধি’ বলে পরিচিত। ধরে নেওয়াই যায়, কোলে-পিঠে করে যে মত তাঁরা বহন করছেন, তা আসলে আসমুদ্রহিমাচল ভারতীয় মননের বহিঃপ্রকাশ। কথাটি বিতর্কিত। পাল্টা যুক্তি হতেই পারে, ‘আধা সামন্ততান্ত্রিক’ ভারতীয় গণতন্ত্রে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমানুষের সমস্ত সামাজিক মতামত সংসদীয় কাঠামোয় প্রতিফলিত হয় না। যা হোক, এ সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে স্বীকার করে নেওয়া ভাল, গত বেশ কয়েক বছর ধরে সমকামিতার প্রশ্নে সাংসদেরা যে প্রগাঢ় নির্লিপ্ত মনোভাব দেখিয়েছেন, তা আসলে ওই আসমুদ্রহিমাচল ‘ভারত’-এর মনের কথা ভেবেই। তারুরের মতো কতিপয় সাংসদের ভার্চুয়াল ‘ইন্ডিয়া’ যা-ই বলুক না কেন! সোশ্যাল নেটওয়ার্কে থাকে এই ‘ইন্ডিয়া’ই। তারাই ফেসবুক-টুইটারের রং বদলায়।
জার্মানি
অন্ধকার নিস্তব্ধ সেই ‘হোমোসেক্সুয়াল মেমোরিয়াল’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল এক সমকামী চিত্রশিল্পী বন্ধু। শোনাচ্ছিল, ২০০৩ সালে জার্মান বুন্দেস্তাগ বা সংসদে বৈঠক করে সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা সমকামীদের মেমোরিয়াল তৈরির প্রস্তাব নেন। ২০০৮ সালে যা খুলে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্য। বন্ধু বলছিল, প্রথম থেকেই মেমোরিয়ালটি নিয়ে নানাবিধ ঝামেলা হয়েছে। বার্লিনের মতো পশ্চিমি ‘প্রগতিশীল’ শহরের বহু মানুষও সমকামীদের মেমোরিয়াল নিয়ে নাক কুঁচকোন। বন্ধুর ধারণা, হয়তো সে কারণেই অন্ধকারে মুখ গুঁজে থাকে ওই মেমোরিয়াল! লুকিয়ে লুকিয়ে বুঝিয়ে দেয়, সে ‘মেনস্ট্রিম’ নয়!
বন্ধুর কথাগুলো সে দিন মিলে গিয়েছিল বরফস্নাত বার্লিনের ইমেজের সঙ্গে। কিছু ক্ষণ পর যা হারিয়ে যাবে ‘গে-নাইটক্লাব’-এর চূড়ান্ত প্রগতিশীল আধুনিকতার উদ্যাপনে।
ভারত
সেই ঘটনার প্রায় ন’মাস পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে ভার্চুয়াল জগতের উল্লাস দেখে মনে পড়ছে বার্লিনের নাইট ক্লাব আর মেমোরিয়ালের বৈপরীত্য। বিপরীত দুই ইমেজ। কেবল মনে হচ্ছে, এ দেশের ভার্চুয়াল জগৎ ও দেশের নাইট ক্লাবের মতোই প্রাণবন্ত। আর আদালতের রায় ওই হারিয়ে-থাকা মেমোরিয়ালটির মতো। যার পাশ দিয়ে মানুষ হাঁটেন, কিন্তু তাকান না। নিরাপদ দূরত্ব মেপে চলেন। এমনকি আলোটুকুও জ্বালানো যায় না, পাছে কেউ দেখে ফেলে।
আলো তো জ্বালছেন না কেউ! মূলস্রোতের কোনও রাজনৈতিক দল একটি শব্দও উচ্চারণ করেছে কি? উল্টে আগমার্কা ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গীয় মার্ক্সবাদী এক নেতা বলেছেন, আদালত যা-ই বলুক, সমকামিতা বিকৃতি। যে যৌন মিলনে সন্তান হয় না, তা কখনওই প্রাকৃতিক হতে পারে না। অতি-দক্ষিণপন্থী একটি দলের নেতা যখন এর পর বৈঠকি আড্ডায় বলবেন, ‘‘উয়ো লোগ ইনসান নেহি হ্যায়। চুন চুন কে হাম মারেঙ্গে, ছোড়ো কোর্ট কি বাত,’’ আশ্চর্য লাগে না।
ভার্চুয়াল ইন্ডিয়ার গা-ঘেঁষে-থাকা ভারতটা এ রকমই। আদালতের রায় শুনে যেখানে সমকামী শিক্ষিকার মা বলেন, ‘‘কোর্টের রায় কি পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমার মুখ বন্ধ করতে পারবে?’’ সেই ভারতেই খাপ পঞ্চায়েত। গণধোলাই। গোরক্ষক বাহিনী। দলিত নিধন। জাতি ভোট। মন্দির বিতর্ক। রিগিং। বুথ জ্যামিং।...
জনপ্রতিনিধিরা ওই সমাজটাকেই চেনেন। তার প্রতিনিধি হিসেবেই গণতন্ত্রের তল্পি বহন করেন। ভার্চুয়াল জগতের রামধনু রং কেনই বা স্পর্শ করবে তাঁদের? ওখানে কি ভোট আছে? বরং স্পর্শ করলেই বিপদ। ভোট ভো-কাট্টা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy